পুতিন কখন ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে সরতে পারেন
রাশিয়ার সেনাবাহিনীকে মোকাবিলায় ইউক্রেনকে ট্যাংক দিয়ে সহায়তার কথা ভাবছে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি। দেশগুলোর ভাষ্য, এই অস্ত্র ব্যবহার করে যুদ্ধক্ষেত্রে বড় সাফল্য পেতে পারে কিয়েভ। এতে যুদ্ধ থামাতে বাধ্য হয়ে শান্তি আলোচনায় বসতে পারে মস্কো। তবে প্রশ্ন রয়েছে, বড় ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ার পরেও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কি যুদ্ধ থামাবেন? সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানে এ নিয়ে একটি নিবন্ধ লিখেছেন কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক ওলগা চিঝ। নিবন্ধটি সংক্ষেপিত অনুবাদ করে প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো।
ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধের এক বছর পূর্ণ হতে চলেছে। যুদ্ধের শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোকে পাশে পেয়েছে ইউক্রেন। রুশ বাহিনীকে ঠেকাতে কিয়েভের হাতে নানা ধরনের সমরাস্ত্র তুলে দিয়েছে তারা। সবশেষ ইউক্রেনকে ট্যাংক দিতে কথা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি। বিষয়টা কিন্তু অবাক করার মতো। কারণ ইউক্রেনকে মিত্র দেশগুলো ট্যাংক দেবে, তা এক মাস আগেও ভাবা যেত না।
শত্রু বাহিনীর ওপর হামলা চালাতে যু্দ্ধের শুরু থেকে পশ্চিমাদের কাছে ভারী অস্ত্র চাচ্ছিল ইউক্রেন। তবে এতোদিন বলতে গেলে তারা শুধু প্রতিরক্ষামূলক অস্ত্রই পেয়েছে। এখন ট্যাংক দেওয়ার বিষয়ে ওয়াশিংটন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ নেতারা বলছেন, তাঁরা চাইছেন যুদ্ধক্ষেত্রে এই অস্ত্র কাজে লাগিয়ে ইউক্রেন যেন বড় সাফল্য পায়। এতে করে বাধ্য হয়ে যুদ্ধ থামাতে শান্তি আলোচনায় বসতে পারে মস্কো।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কথাই বলা যায়। দুই বছর পর তিনি হয়তো আর ইউক্রেন ইস্যুতে পশ্চিমাদের এক ছাতার তলা ধরে রাখার মতো অবস্থায় থাকবেন না। এতে করে তাদের মধ্যে সামান্য কোনো ফাটল দেখা দিলে হাওয়া মস্কোর দিকে বইতে শুরু করতে পারে।
তবে রাশিয়া আদৌ শান্তি আলোচনার পথে হাঁটবে কি না—এমন প্রশ্ন উঠতে পারে। কারণ পশ্চিমা নেতাদের সঙ্গে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পার্থক্য রয়েছে। পশ্চিমা নেতারা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন পেয়ে ক্ষমতায় বসেন। পুতিনের বিষয়টি আলাদা। তিনি ক্ষমতায় টিকে আছেন তাঁর অতি বিশ্বস্ত হাতেগোনা কয়েকজন ব্যক্তির সমর্থনে। সরকার বা ব্যবসা–বাণিজ্যে প্রভাব ধরে রাখতে এই লোকগুলোই আবার পুতিনের ওপর নির্ভর করেন। তাই পুতিনের ছড়ির ইশারার বাইরে যাওয়ার কোনো ক্ষমতা তাঁদের নেই।
এ থেকে বড় দুটি সুবিধা ভোগ করে থাকেন পুতিন। প্রথমটা হলো, তিনি দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকতে পারছেন। ফলে ইউক্রেন যুদ্ধ আরও দীর্ঘায়িত করতে পারেন তিনি। এ সময় তিনি পশ্চিমা দেশগুলোতে ইউক্রেনপন্থী নেতাদের ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকবেন। বলা যায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কথাই। দুই বছর পর তিনি হয়তো আর ইউক্রেন ইস্যুতে পশ্চিমাদের এক ছাতার তলে ধরে রাখার মতো অবস্থায় থাকবেন না। এতে করে তাঁদের মধ্যে সামান্য কোনো ফাটল দেখা দিলে হাওয়া মস্কোর দিকে বইতে শুরু করতে পারে।
ইউক্রেনীয়রা যদি নিজ দেশ থেকে সব রুশ সেনাদের তাড়িয়ে দিতেও সক্ষম হয়, তারপরেও রাশিয়ার আগ্রাসন থামবে না। ইউক্রেনের ভূখণ্ডকে নিজেদের বলে দাবি করে যাবে মস্কো। ক্রেমলিন থেকে আসবে একের পর এক হুমকি, ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ও সীমান্ত সংঘাত।
পুতিনের দ্বিতীয় সুবিধাটি রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে। যেহেতু ক্ষমতায় আসার জন্য তাঁর দেশের মানুষের সমর্থনের দরকার পড়ে না, তাই তাদের কাছে কোনো নীতি–সিদ্ধান্তের জবাবদিহি করার কথাও ভাবেন না তিনি। পুতিন কী সিদ্ধান্ত নেবেন, তা ঠিক হয় তাঁর ঘনিষ্ঠ গুটিকয়েক মানুষের স্বার্থের ভিত্তিতে। এই লোকগুলো মূলত রুশ সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থায় অভিজাত শ্রেণির কর্মকর্তা। তাঁরা ইউক্রেন যুদ্ধের পক্ষে। যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতির চেয়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অঞ্চলগুলো একত্রিত করায় বেশি লাভ দেখছেন তাঁরা। এমনকি তাঁদের অনেকেই রাশিয়ার সব নাগরিককে সেনাবাহিনীতে যুক্ত করার কথা তুলেছেন।
পশ্চিমাদের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে তারা পুতিনের এই দ্বিতীয় সুবিধা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না, রাশিয়াকে বিচার করছে নিজেদের দাঁড়িপাল্লায় ফেলে। পশ্চিমা নেতারা ভাবছেন, যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি রাশিয়াকে দমিয়ে দিতে পারবে। ইউক্রেনীয় সেনাদের আরও অগ্রগতি হলে আপস করতে রাজি হবে মস্কো। তবে বাইডেন ও তাঁর ইউরোপীয় মিত্ররা ভুলে গেছেন, কর্তৃত্ববাদী নেতাদের গণতান্ত্রিক নেতাদের মতো জনগণের চাপ সামলাতে হয় না। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কফিনে শুয়ে নিজেদের সেনারা দেশে ফিরছেন—এটা গণতান্ত্রিক নেতাদের ভাবমূর্তির জন্য হানিকর। তবে যাঁদের ক্ষমতায় থাকতে জনসমর্থনের প্রয়োজন পড়ে না, তাঁদের কাছে এটা চিন্তার কোনো বিষয় নয়। তাই ক্ষয়ক্ষতি যতই হোক না কেন, তা পুতিনের মন গলাবে না।
ইউক্রেনের জন্য এর অর্থ কী দাঁড়াচ্ছে? অর্থটা হলো রাশিয়া থামবে না। একটি রুশ লোককথা আছে, যার অর্থ, কয়েকবার প্রচেষ্টার পরই সফলতা আসে। নিজ দেশের সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রে রাশিয়া মনে হয় ওই লোককথাই কাজে লাগায়। ইতিহাস বলছে, সোভিয়েত–ফিনিশ যুদ্ধ থেকে শুরু করে চেচনিয়া যুদ্ধ পর্যন্ত রুশ সেনাবাহিনী প্রথমে ব্যর্থ হলেও দ্বিতীয় চেষ্টায় সফল হয়েছে।
ইউক্রেনীয়রা যদি নিজ দেশ থেকে সব রুশ সেনাদের তাড়িয়ে দিতেও সক্ষম হয়, তারপরেও রাশিয়ার আগ্রাসন থামবে না। ইউক্রেনের ভূখণ্ডকে নিজেদের বলে দাবি করে যাবে মস্কো। ক্রেমলিন থেকে আসবে একের পর এক হুমকি, ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ও সীমান্ত সংঘাত। বড় কথা হলো যাঁরা নিজেদের বাঁচাতে লড়াই করে, তাঁদের জন্য চূড়ান্ত জয় বলে কিছু নেই। তাই ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়ার স্বপ্নে জল ঢেলে দেওয়া কিয়েভের লক্ষ্য হতে পারে না। নিজেদের রক্ষায় তারা সর্বোচ্চ যেটা করতে পারে সেটা হলো, আরও দেশের সঙ্গে মৈত্রী গড়ে তোলা এবং বিশ্বমানের অত্যাধুনিক একটি সামরিক বাহিনী প্রস্তুত রাখা।