ফ্রান্সের আলোচিত ধর্ষণ মামলার রায় ঘিরে পাঁচটি প্রশ্ন

রায়ের পর অ্যাভিগনোন আদালতকক্ষ ত্যাগ করছেন গিস লে। ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪ছবি: এএফপি

ফ্রান্সের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত ধর্ষণ মামলা এটি। ভুক্তভোগীর পরিচয়, সামাজিক মর্যাদা—এসব বিষয় বিবেচনা করে দেশটিতে সাধারণত এ ধরনের মামলার বিচারকাজ উন্মুক্ত থাকে না।

কিন্তু ভুক্তভোগী গিস লের অনুরোধেই আলোচিত এই মামলার বিচারকাজ সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। ১৫ সপ্তাহের বিচারপ্রক্রিয়া শেষে গত বৃহস্পতিবার মামলার রায় হয়।

মামলায় গিস লের সাবেক স্বামী ও প্রধান আসামি ডোমিনিক পেলিকোতকে ২০ বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন ফ্রান্সের অ্যাভিগনোন শহরের একটি আদালত।

এ ছাড়া আরও ৫০ আসামিকে ৩ থেকে ১৫ বছর মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তবে তাঁদের মধ্যে দুজনের কারাদণ্ড স্থগিত করা হয়েছে।

গিস লেকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করতেন ডোমিনিক। এরপর অন্য পুরুষ দিয়ে স্ত্রীকে ধর্ষণ করাতেন তিনি।

এভাবে চলেছিল প্রায় এক দশক। একবার-দুবার নয়, এমন ভয়ংকর ঘটনা ৯২ বার ঘটেছে গিস লের সঙ্গে। ডোমিনিক অনলাইনে এসব লোক ঠিক করতেন।

গত সেপ্টেম্বরে আলোচিত এ মামলার বিচার শুরু হয়। ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্য ও কৌঁসুলিরা সব আসামির যেমন শাস্তি আশা করেছিলেন, তেমনটি না হওয়ায় তাঁরা কিছুটা হতাশ।

রায় শেষে গিস লের পরিবারের এক সদস্য বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ডোমিনিককে লঘু শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এ শাস্তিতে গিস লের সন্তানেরা হতাশ।

রায় হয়ে গেলেও গিস লের মামলা, পরবর্তী সম্ভাব্য ঘটনাপ্রবাহসহ কিছু বিষয় নিয়ে এখনো কয়েকটি প্রশ্ন রয়ে গেছে। এমন কিছু প্রশ্ন সামনে এনেছে বিবিসি।

মামলার শুনানিকালে আদালতকক্ষে থাকা ডোমিনিক পেলিকোতের স্কেচ। ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
ছবি: এএফপি

গিস লে এখন কী করবেন

গত সেপ্টেম্বরে অ্যাভিগনোনের আদালতে মামলাটির বিচার শুরু হওয়ার আগপর্যন্ত গিস লে ফ্রান্সে পরিচিত কেউ ছিলেন না। কিন্তু তিনি এখন ফ্রান্সজুড়ে পরিচিত একটি নাম।

ইতিমধ্যে গিস লে জানিয়েছেন, তিনি তাঁর সাবেক স্বামীর পদবী ‘পেলিকোত’ আর ব্যবহার করবেন না।

কিন্তু এতটা আলোচিত হওয়ার পর গিস লের পক্ষে কি আর সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করা সম্ভব হবে? তাঁর জন্য তা অসম্ভবই হবে।

ক্যারোলিনের সঙ্গে কী হয়েছিল

ডোমিনিকের অপরাধের বিষয়টি সামনে আসার কিছুদিন পর তাঁর মেয়ে ক্যারোলিন ডারিয়ানকে তলব করে পুলিশ।

ক্যারোলিনকে পুলিশ স্টেশনে গেলে তাঁকে কিছু ছবি দেখানো হয়। ছবিতে এক নারীকে দৃশ্যত অজ্ঞান অবস্থায় দেখা যায়। তাঁর পরনে ছিল অপরিচিত অন্তর্বাস।

পরবর্তী সময়ে ক্যারোলিন বলেন, ছবিতে তিনি নিজেকে আবিষ্কার করার পর তাঁর জীবন ‘থমকে’ গিয়েছিল।

মেয়ে ক্যারোলিনকে স্পর্শ করার কথা ডোমিনিক বারবার অস্বীকার করে এসেছেন। তবে আদালতে শুনানি চলাকালে বিভিন্ন সময় ক্যারোলিনকে যন্ত্রণাকাতর ও বিধ্বস্ত মনে হয়েছে।

ক্যারোলিন বলেন, তিনি কখনো তাঁর পিতাকে বিশ্বাস করবেন না। তাঁর দিকে ডোমিনিক ‘অভদ্র’ চোখে তাকিয়েছেন বলেও অভিযোগ করেছেন ক্যারোলিন।

কতজন আসামি আপিল করবেন

মামলায় ডোমিনিক ছাড়া বাকি আসামিরা বাদীপক্ষের কৌঁসুলিদের দাবির চেয়ে কম কারাদণ্ড পেয়েছেন।

এখন প্রশ্ন হলো, দণ্ড পাওয়া আসামিদের মধ্যে কতজন আপিল করবেন?

মামলায় রায় ঘোষণার পর আসামিপক্ষের কিছু আইনজীবীকে সন্তুষ্ট মনে হয়েছে। এর অর্থ হলো, তাঁরা নিজেরা মক্কেলদের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার জন্য নিরুৎসাহিত করবেন।

বিচারকাজ শুরুর আগে আসামিদের অনেকে আটক ছিলেন। এখন তাঁদের কারাদণ্ডের মেয়াদ থেকে বিচারের আগে আটক থাকার সময় বাদ যাবে। ফলে কেউ কেউ সাজাভোগ শেষে শিগগির কারাগার থেকে মুক্তি পেতে পারেন।

রায়ের পর দুই ব্যক্তি ইতিমধ্যে আপিল করেছেন। তাঁদের প্রত্যেকে পেয়েছেন আট বছরের কারাদণ্ড।

১২ বছর কারাদণ্ড পাওয়া আরেক ব্যক্তির আইনজীবী জানিয়েছেন, তাঁর মক্কেল আপিল করবেন।

আরও অনেকে নির্ধারিত ১০ দিনের মধ্যে আপিল করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন
মামলার শুনানিকালে অ্যাভিগনোন আদালতকক্ষের স্কেচ। ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
ছবি: এএফপি

ডোমিনিক কি অন্য মামলাতেও দোষী সাব্যস্ত হবেন

ডোমিনিক ১৯৯৯ সালে প্যারিসের উপকণ্ঠে ২৩ বছর বয়সী আবাসন খাত-সংশ্লিষ্ট এক নারীর ওপর হামলা ও ধর্ষণচেষ্টার কথা স্বীকার করেছেন।

ইথার মিশ্রিত একটি কাপড় দিয়ে মারিনো (ছদ্মনাম) নামের এই নারীর মুখ চেপে ধরেছিলেন ডোমিনিক। কিন্তু মারিনোর প্রতিরোধের মুখে একপর্যায়ে ডোমিনিক পালিয়ে যান।

গিস লের মামলায় ২০২১ সালে ডোমিনিক গ্রেপ্তার হন। এর আগপর্যন্ত মারিনোর সঙ্গে ঘটা ঘটনার বিষয়ে ডোমিনিকের সম্পৃক্ততা জানা যায়নি।

গ্রেপ্তার হওয়ার পর মারিনোর জুতায় পাওয়া রক্তের ফোঁটার সঙ্গে ডোমিনিকের ডিএনএ মিলিয়ে দেখা হয়। এরপর ডোমিনিক তাঁর অপরাধ স্বীকার করেন।

ডোমিনিকের বিরুদ্ধে আরেকটি ধর্ষণ ও হত্যাসংক্রান্ত মামলা আছে। সোফি নারমে নামের আবাসন খাতের এক তরুণীকে ১৯৯১ সালে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়েছিল। এই মামলায় কোনো ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়নি।

তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলেন, দুই ঘটনার মধ্যে অনেক মিল আছে, যা কাকতালীয় হতে পারে।

ডোমিনিক এই ঘটনায় যুক্ত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে একই ধরনের আরও কিছু মামলা আছে।

রায় কি অবস্থা বদলাবে

প্যারিসের এক বাসিন্দা বিবিসিকে বলেন, ডোমিনিকের বিচারের ‘পূর্ব’ ও ‘পরবর্তী’ অবস্থা বলে একটি ব্যাপার ভবিষ্যতে দেখা যাবে।

ডোমিনিকের বিচার ঘিরে গত কয়েক মাসে ফ্রান্সের সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। ধর্ষণ, সম্মতি, নারীদের প্রতি সহিংসতা নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক ও আলাপ-আলোচনা হয়েছে।

অনেকে ধর্ষণের শাস্তি কঠোর করা, তথা বাড়ানোর কথা বলেছেন। আবার ‘সম্মতি’ বিষয়ে ফরাসি আইনে পরিবর্তন আনার আহ্বানও জানিয়েছেন অনেকে।

আরও পড়ুন