কামিকাজে ড্রোন দিয়ে রুশ সেনাদের নাস্তানাবুদ: ‘এ যেন কম্পিউটারে গেম খেলার মতো’
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে অভিযান শুরুর আগে ওলেকসান্দ্র ছিলেন একজন তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) কর্মকর্তা। কাজ করতেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। পরে সে কাজ ছেড়ে দেন তিনি। এখন মন দিয়েছেন কামিকাজে বা আত্মঘাতী ড্রোন দিয়ে রুশ বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করায়।
৩২ বছর বয়সী ওলেকসান্দ্র ইউক্রেনের সবচেয়ে দক্ষ কামিকাজে ড্রোনচালকদের একজন। গত মে মাস থেকে এ কাজ করছেন তিনি। তবে এখনো দেশটির সেনাবাহিনীতে যোগ দেননি। যুদ্ধের সম্মুখসারিতে যখন যেখানে প্রয়োজন হয় ছুটে যান। তারপর ড্রোন দিয়ে করেন শত্রুনিধন। ওলেকসান্দ্র বলেন, ‘ড্রোন দিয়ে আমার মতো ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে এমন কাউকে এখনো দেখিনি।’
হাতে থাকা মুঠোফোন ঘেঁটে নিজের করা ধ্বংসযজ্ঞের ফিরিস্তি দিলেন আলেকসান্দ্র। একে একে বলে গেলেন তাঁর ধ্বংস করা ট্যাংকসহ ২০টি সাঁজোয়া যানের নাম। এ ছাড়া তিনি রাশিয়ার আরও ৬টি ট্যাংক ও ১০টি সাঁজোয়া যানের ক্ষতি করেছেন। সেগুলোও যুদ্ধে আর ব্যবহার করার হালে নেই। আলেকসান্দ্রর মতে, যানগুলোর প্রতিটিই যুদ্ধক্ষেত্রে রুশ বাহিনীর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
যুদ্ধক্ষেত্রে ওলেকসান্দ্র যে ড্রোনগুলো ব্যবহার করছেন, সেগুলোর যন্ত্রাংশ অনলাইনের মাধ্যমে চীন থেকে কিনে আনা। রাজধানী কিয়েভের একটি ভবনের ২৪ তলায় সেগুলো একত্র করে ড্রোনে রূপ দেন তাঁর দুই বন্ধু।
ওলেকসান্দ্রর হামলার সময় অনেক রুশ সেনা হতাহত হন। এ নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই তাঁর। তিনি বলেন, গত শুক্রবার সকাল সোয়া সাতটায় দক্ষিণ ইউক্রেনের জাপোরিঝঝিয়া অঞ্চলের রোবোতিনে গ্রামে একটি রুশ অবস্থানে ড্রোন দিয়ে হামলা চালান তিনি। তাতে রাশিয়ার দুই সেনা নিহত ও ছয়জন আহত হন। কিছুক্ষণ আগে তিনি জানতে পেরেছেন, রাশিয়ার ওই অবস্থান এখন দখলে নিয়েছেন ইউক্রেনের সেনারা।
ওলেকসান্দ্রর কথাগুলো যে সত্য, তা প্রমাণে নিজের কাছে কিছু ভিডিও ফুটেজ রেখেছেন। শুক্রবার সকালের একটি ভিডিও দেখালেন তিনি। দেখা যায়, ইউক্রেনের সেনাদের দিকে পরিখা থেকে গুলি ছুড়ছেন রাশিয়ার সেনারা। তবে আকাশ থেকে যে তাঁদের ওপর বিপর্যয় নেমে আসতে পারে, তা নিয়ে মোটেও সতর্ক ছিলেন না। কিছুক্ষণ বাদেই ওলেকসান্দ্রর একটি ম্যাভিক–৩ ড্রোন তাঁদের ওপর আছড়ে পড়ে বিস্ফোরিত হয়।
আছে কিছু অভিযোগ
নিরাপত্তার খাতিরে নিজের পুরো নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি ওলেকসান্দ্র। যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর অবদান ইউক্রেন বাহিনীকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করছে। তবে কিছু অভিযোগও রয়েছে তাঁর। চলতি সপ্তাহের শুরুর দিকে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেকসি রেজনিকভ দেশটির সশস্ত্র বাহিনীকে নতুন প্রযুক্তির ড্রোন (ফার্স্ট পারসন ভিউ ড্রোন–এফপিভি) দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে ওলেকসান্দ্র বা তাঁর সহযোদ্ধাদের—কারও হাতে সেই ড্রোন পৌঁছায়নি। এমনকি তাঁরা ড্রোনটি চোখেও দেখেননি।
যুদ্ধক্ষেত্রে ওলেকসান্দ্র যে ড্রোনগুলো ব্যবহার করছেন, সেগুলোর যন্ত্রাংশ অনলাইনের মাধ্যমে চীন থেকে কিনে আনা। রাজধানী কিয়েভের একটি ভবনের ২৪ তলায় সেগুলো একত্র করে ড্রোনে রূপ দেন তাঁর দুই বন্ধু। ওলেকসান্দ্র প্রতি মাসে যখন কিয়েভে যান, তখন ড্রোনগুলো সঙ্গে করে জাপোরিঝঝিয়াতে নিয়ে আসেন। অনেক সময় সেগুলো ডাকযোগেও পাঠানো হয়।
ওলেকসান্দ্রর ড্রোনগুলো বানাতে খরচ পড়ে ৪০০ ডলারের মতো। এই অর্থ দেয় বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। তাঁরা নিজেদের পরিচয় জানান না। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে সামরিক সরঞ্জামের ঘাটতির কারণে সশস্ত্র বাহিনীর অন্য ইউনিটগুলোরও বাইরে থেকে ড্রোন কিনতে হয়। তাদের প্রতিটি ড্রোন কিনতে খরচ পড়ে ৬৫০ ডলার করে। ওলেকসান্দ্র অভিযোগ করে বলেন, রাশিয়া হাজার হাজার ড্রোন তৈরি করে সেগুলো কম দামে যুদ্ধের সম্মুখসারিতে পাঠাচ্ছে। তবে ইউক্রেনে সেটি করা হচ্ছে না।
যেভাবে কাজ করেন তিনি
গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে ড্রোন নিয়ে ওলেকসান্দ্রর জানাশোনা ছিল খুবই কম। পরে তিনি দেখলেন, ড্রোন যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তখনই তিনি ইন্টারনেট থেকে একটি ড্রোন কিনে হাত পাকাতে শুরু করেন। তাঁর জবানিতে, ‘আমি এমন কিছু খুঁজে বের করতে চেয়েছিলাম, যেটিতে আমি সবচেয়ে বেশি কাজে লাগতে পারি।’
এরপর একদিন ওলেগ সেন্তসভ নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হয় ওলেকসান্দ্রর। তিনি একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক ও অ্যাকটিভিস্ট। দুজনের বন্ধুত্ব হয়। এই বন্ধুর সহযোগিতায় সামরিক বাহিনীর একটি দলে ড্রোনচালক হিসেবে যোগ দেন ওলেকসান্দ্র। এর পর থেকেই নিজের দক্ষতার পরিচয় দিয়ে আসছেন। নজরদারি ড্রোন নিয়ে কাজ করার সময় একা থাকতে পছন্দ করেন ওলেকসান্দ্র। সাধারণত এক বর্গকিলোমিটার এলাকায় শত্রুপক্ষের ওপর নজরদারি করেন তিনি। এ সময় তিনি রিমোট কন্ট্রোলার নিয়ে ৮০০ মিটার থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করেন।
একদিন ওলেগ সেন্তসভ নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হয় ওলেকসান্দ্রর। ওলেগ সেন্তসভ একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক ও অ্যাকটিভিস্ট। দুজনের বন্ধুত্ব হয়। সেন্তসভের সহযোগিতায় সামরিক বাহিনীর একটি দলে ড্রোনচালক হিসেবে যোগ দেন ওলেকসান্দ্র।
তবে কামিকাজে ড্রোনের ক্ষেত্রে তিন থেকে চারজনের দল নিয়ে মাঠে নামেন ওলেকসান্দ্র। তাঁদের একজন একটি নজরদারি ড্রোন পরিচালনা করেন। আরেকজন চালান কামিকাজে ড্রোন। এই ড্রোনে ৬০০ গ্রাম পর্যন্ত বিস্ফোরক বাঁধা থাকে। দলের অন্যদের কাজ হয় বিভিন্ন সংকেত ও যোগাযোগের বিষয়টি দেখভাল করা। এ সময় ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর সদস্যরা লক্ষ্যবস্তুর ৪০০ মিটার থেকে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থান করেন। এই সেনা সদস্যদের দলের একটি নাম রয়েছে—‘ফোর্স মাজেউর’।
গত জুন থেকে ফোর্স মাজেউরে কাজ করছেন জুনিয়র সার্জেন্ট পেত্রো শতাঙ্কো (৩৩)। তিনি অভিযান শুরু করার সবুজ সংকেত দিয়ে থাকেন। ওলেকসান্দ্রর দৃঢ় সংকল্প দেখে অনুপ্রেরণা পান শতাঙ্কো। তাঁর ভাষায়, ‘(ওলেকসান্দ্রর মতো) এমন মনোবলের সঙ্গে লড়াই করার প্রেরণা আপনি সব জায়গায় খুঁজে পাবেন না।’
যুদ্ধক্ষেত্রে সফল হতে গেলে খোশমেজাজে থাকতে হবে বলে মনে করেন ওলেকসান্দ্র। তিনি বলেন, ‘জানেন, আমার কাজটা কম্পিউটারে গেম খেলার মতো। এটা খুবই মজার। আপনি যখন মজা পাবেন, যখন আয়েশ করে কিছু করতে পারবেন, তখন কাজটা সহজ হয়ে যাবে। আর আপনার মাথায় যখন চিন্তা থাকবে, কোনো কাজই ঠিকঠাকভাবে করতে পারবেন না। কেউই করতে পারে না।’