ভাগনার বিদ্রোহের পর পুতিনকে নিয়ে কতটা উদ্বিগ্ন ইউরোপ

ভ্লাদিমির পুতিন
ছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে নিয়ে নতুন সতর্কবার্তা দিয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) কর্মকর্তারা। তাঁরা বলছেন, ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভাগনারের বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সেটা হলো রাজনৈতিকভাবে পুতিনকে যতটা দুর্বল মনে করা হচ্ছিল, তার চেয়ে বেশি দুর্বল। এই বিদ্রোহের কারণে তিনি আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারেন।

বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে গত বৃহস্পতিবার ইইউর সম্মেলনে রাশিয়ার এই বিদ্রোহ নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে ইইউর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা আবারও বলেছেন, এই বিদ্রোহের সঙ্গে ইউরোপের কোনো যোগসূত্র নেই। তবে পুতিনকে নিয়ে এখন উদ্বেগে রয়েছে ইউরোপ।

এ প্রসঙ্গে ইইউর পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেল বলেন, দুর্বল পুতিন আরও বেশি বিপজ্জনক। তিনি একচেটিয়া ক্ষমতা হারিয়েছেন। ভাগনার বিদ্রোহের কারণে পুতিন এবার পুরোপুরি শুদ্ধি অভিযানে পথে হাঁটবেন এবং আরও বেশি দৃঢ়চেতা হয়ে উঠবেন।

বোরেল বলেন, ইইউর দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এই পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেছে। তারা মনে করছে, রাশিয়াকে এখন আরও গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। কারণ, দেশটির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বিষয়-আশয় সামনে এসেছে।

তবে পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোর মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ ভিন্ন কথা বলেছেন। তিনি মনে করেন, ভাগনার বিদ্রোহের কারণে রাশিয়ায় ফাটল ধরেছে এবং দেশটি বিভক্ত হয়ে পড়ছে—এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আসেনি।

স্টলটেনবার্গ বলেন, রাশিয়ায় বিভক্তি ও ফাটল আছে, এর একটি চিত্র উঠে এসেছে এই বিদ্রোহের মাধ্যমে। তবে এটা মাথায় রাখতে হবে, এটা রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়।

এ প্রসঙ্গে জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ বলেন, রাশিয়ার সরকার বদল করা লক্ষ্য নয়।

ইউরোপের নেতারা রাশিয়ার বিদ্রোহকে যেভাবে দেখছেন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বিষয়টিকে সেভাবে দেখছেন না। বৃহস্পতিবারের ওই সম্মেলনে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়েছিলেন জেলেনস্কি। তাঁর মতে, বিদ্রোহ পুতিনকে আরও বেশি বিপজ্জনক করে তুলবে। একই সঙ্গে তিনি কখন কী ঘটিয়ে ফেলবেন, সেটা আন্দাজ করা মুশকিল হয়ে পড়বে।

জেলেনস্কি বলেন বলেন, ‘আমরা এখন এটা দেখতে পাচ্ছি, তারা (রাশিয়া) দুর্বল। যা আমাদের খুবই প্রয়োজন ছিল।’ তাঁর মতে, রাশিয়া দুর্বল হলে বাকিরা নিরাপদ হবে। তাদের পরাজয় এই যুদ্ধের ইতি ঘটাবে।

পুতিনের সরকারব্যবস্থায় ফাটল
ভাগনার গ্রুপের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল প্রেসিডেন্ট পুতিনের। কিন্তু বিদ্রোহের পর ইইউর নেতারা এ বিষয়ে একমত হয়েছেন, এই বাহিনীর ওপর যে কর্তৃত্ব ছিল, তাতে ধাক্কা খেয়েছেন পুতিন।

পুতিনের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন প্রতিবেশী দেশ লিথুয়ানিয়ার প্রেসিডেন্ট গিতানাস নওসেদা। তিনি বলেন, ‘শক্তিশালী পুতিনের চেয়ে দুর্বল পুতিন ভয়ংকর, আমি এর সঙ্গে একমত নই। আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে এবং সংকল্পবদ্ধ হতে হবে।’ বর্তমান সময়কে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত বলে আখ্যা দিয়েছেন তিনি।

ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েনের মতে, পুতিনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যে ফাটল রয়েছে, এই বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে তা সামনে এসেছে। গত শনিবারের এই বিদ্রোহের পরাঘাত দেখা যাবে নিকটতম সময়ে।

ভাগনারের এই বিদ্রোহের পর বেলারুশে চলে গেছেন তাদের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিন। এই বাহিনীর সদস্যরাও সেখানে যেতে পারেন, এ আলোচনাও চলছে। এ প্রসঙ্গে ইইউর বিভিন্ন দেশ ও সেখানকার প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ভাগনারের বিদ্রোহের কারণে যে অস্থিতিশীলতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে, এর মধ্য দিয়ে ইউক্রেনের প্রতি ইইউর যে প্রতিশ্রুত অস্ত্র-গোলাবারুদ দিয়ে তা শুধু সংহত করলেই হবে না, সংঘাত যাতে ইউরোপে ছড়িয়ে না পড়ে, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে এস্তোনিয়ার প্রধানমন্ত্রী কাজা কালাস বলেন, এখন দ্বিধার কোনো জায়গা নেই। আগ্রাসনের চড়া মূল্য যাতে রাশিয়াকে দিতে হয়, সেই পদক্ষেপ নিতে হবে।

ভাগনারের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিন
ছবি: এএফপি

ন্যাটোর সাহায্য
ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য নয়। দেশটির ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। তবে আগামী ১১ ও ১২ জুলাই ন্যাটোর সম্মেলনে এ নিয়ে আলোচনা হবে। ইউক্রেনকে যদি এখন সদস্যপদ না–ও দেওয়া যায়, তবে আরও কীভাবে সাহায্য করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করা হবে।

এর পেছনে যুক্তিযুক্ত কারণ রয়েছে। ভাগনার বিদ্রোহের পর ইউক্রেন যুদ্ধে রুশ বাহিনীর এক ডেপুটি কমান্ডারকে আর দেখা যাচ্ছে না। এ ছাড়া রাশিয়ার কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের পাওয়া যাচ্ছে না। রাশিয়ার এই আচরণ সন্দেহজনক মনে করা হচ্ছে।

রাশিয়ার জেনারেল নিখোঁজ, সন্দেহ
ভাগনার যোদ্ধাদের প্রতি সব রুশ কমান্ডারই যে নাখোশ ছিলেন, এমনটা নয়। গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, ভাড়াটে এই যোদ্ধাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন রুশ জেনারেল সের্গেই সুরোভিকিন। ভাগনারের বিদ্রোহের পর আর তাঁকে দেখা যাচ্ছে না।

বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম খবর প্রকাশ করেছে, সুরোভিকিনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে রাশিয়ার সরকার এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। শুধু ক্রেমলিন মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, এটা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ব্যাপার।

সুরোভিকিনের জন্য কী অপেক্ষা করছে, তা এখনো বলা মুশকিল। ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার বলছে, সুরোভিকিনকে নিয়ে পেসকভের মন্তব্য না করাটা এটাই ইঙ্গিত দেয় যে তাঁর বিরুদ্ধে হয়তো তদন্ত চলছে। প্রতিষ্ঠানটি এ–ও জানিয়েছে, তারা রাশিয়ার সূত্রগুলোর কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পাচ্ছে। তারা এমনও জানতে পেরেছে, ভাগনার বিদ্রোহের পর সুরোভিকিনকে জিজ্ঞাসা বাদ করা হয়েছে। এরপর তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার বলছে, বিদ্রোহের এ ঘটনার পর সুরোভিকিন বা যেকোনো কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা স্বাভাবিক।

কিন্তু এ ঘটনার পর সুরোভিকিনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। পুতিন আর সুরোভিকিনকে বিশ্বাস করবেন কি না, এ প্রশ্ন খানিকটা এড়িয়ে গেছেন পেসকভ। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট পুতিন শুধু প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু ও চিফ অব স্টাফ ভালেরি গেরাসিমভের সঙ্গে কাজ করেন।