নতুন প্রযুক্তির পরীক্ষাগার হয়ে উঠেছে ইউক্রেন

লেজার-স্ক্যানার ব্যবহার করে ধরে রাখা হচ্ছে ১৮৮৭ সালে নির্মিত খারকিভ ফায়ার স্টেশনটির স্থাপত্যনকশা
ছবি: এএফপি

ইউক্রেনের অনেক এলাকা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন। রুশ বাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র হামলার শিকার হয়েছে ইউক্রেনের বিদ্যুৎ অবকাঠামোগুলো। এতে তীব্র শীতের মধ্যেও অনেক মানুষকে বিদ্যুৎবিহীন জীবন কাটাতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের মানুষকে টিকে থাকতে সাহায্য করছে প্রযুক্তি। বর্তমান ও ভবিষ্যতের কথা বিবেচনায় ইউক্রেনের নিজস্ব উদ্ভাবিত কিছু প্রযুক্তির পাশাপাশি মিত্রদের কাছ থেকে পাওয়া প্রযুক্তি তাদের সহায়–সম্বল হয়ে উঠেছে।

ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ থেকে দুই হাজার মাইল দূরে স্কটল্যান্ডের একটি কার্যালয়ে যুদ্ধের বিভিন্ন তথ্য নিয়ে কাজ চলছে। সেখানে ইউক্রেনের ম্যাপের ওপর বিভিন্ন রঙিন বিন্দু ফুটে উঠছে। এসব বিন্দু মূলত ইউক্রেনের একেকটি স্থান, যেখানে যুদ্ধের ফলে ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি হচ্ছে। এ প্রযুক্তি মূলত লাইভ ট্র্যাকার। স্কটিশ মানবিক বেসরকারি সংস্থা হ্যালো ট্রাস্ট এই লাইভ ট্র্যাকার নিয়ে কাজ করছে। সংস্থাটি মূলত কোনো সংঘাতে জীবন রক্ষা করে এবং ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জীবিকা পুনরুদ্ধার করে। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তাদের লক্ষ্য হলো জীবন রক্ষা করা এবং জীবিকা পুনরুদ্ধার করা। স্থলমাইন এবং অন্যান্য বিস্ফোরক সাফ করে তারা সংঘাতের পরে দেশ পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে।

প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয়ে লাইভ ট্র্যাকারে ইউক্রেনে রুশ বোমা হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেটার তথ্য চার্ট আকারে তুলে ধরা হচ্ছে। বোমা হামলার পর ক্ষয়ক্ষতির সরাসরি তথ্য, যে ধরনের বোমা আঘাত হানছে, তার তথ্য তুলে ধরা হচ্ছে। এ ধরনের তথ্য আগে জানা সম্ভব ছিল না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে হামলার তথ্য প্রায় তাৎক্ষণিক (রিয়েল টাইম) জানা যাচ্ছে। এ বিষয়টি প্রতিরক্ষা ও পরে ইউক্রেনের পুনর্গঠনের কাজে লাগতে পারে।

আরও পড়ুন

গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলার নির্দেশ দেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তাঁর এ নির্দেশের আগে ইউক্রেনের ডিজিটাল অর্থনীতি ও প্রযুক্তি খাত তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু যুদ্ধ এসে সবকিছু থমকে দেয়। যুদ্ধের এক বছর পেরিয়ে গেছে। যুদ্ধের শুরু থেকেই প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করে ইউক্রেন। দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি দেশের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছেও সহায়তা চান। গত জুন মাসে তিনি হলোগ্রামের মাধ্যমে ইউরোপিয়ান কয়েকটি প্রযুক্তি সম্মেলনে হাজির হন। সেখানে তিনি ইউক্রেনের বর্তমান পরিস্থিতির উপযোগী প্রযুক্তি সুবিধা সহায়তা চান। এর বিনিময়ে পরে ইউক্রেনে বিনিয়োগ সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। এতে ইউক্রেন বিভিন্ন ধরনের উদ্ভাবনী সুবিধা ব্যবহারের সুবিধা পেতে শুরু করে।

আরও পড়ুন

বিদেশি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইউক্রেনের পক্ষ থেকে ‘দিয়া সিটি’তে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তবে কোনো ম্যাপে দিয়া সিটি নামের শহরের অস্তিত্ব পাওয়া যাবে না।

দিয়া অর্থ অ্যাকশন বা কার্যক্রম। এটি মূলত একধরনের ভার্চ্যুয়াল শহর। বিদেশি মেধাবী উদ্ভাবকদের কাছে টানতে এ বছরের শুরুতে জেলেনস্কি এই শহর উদ্বোধন করেন। এ শহরের নিজস্ব আইন ও করের বিধান রয়েছে। এখানে ভার্চ্যুয়ালি নিজের জায়গা কিনে রাখার সুবিধা রয়েছে। ভার্চ্যুয়াল এই আবাসস্থল কিনে রাখলে নানা সুবিধা পাওয়া যাবে। এর একটি হচ্ছে ইউক্রেনে ব্যবসা–বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বড় ধরনের কর ছাড়।

তবে ইউক্রেনকে যেসব প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সহায়তা দিচ্ছে, সব প্রতিষ্ঠান মুনাফার জন্য ছুটছে না। অনেক প্রতিষ্ঠান ইউক্রেনের বাস্তবতায় তাদের প্রযুক্তি পরীক্ষা করে দেখতে চাইছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালফোর্নিয়াভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এসরি এমনই একটি প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠান মূলত ভৌগোলিক তথ্যযুক্ত সফটওয়্যার  তৈরিতে বিশেষ পারদর্শী। তারা মূলত রুশ গোলার আঘাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ পর্যবেক্ষণ করে এবং কী ধরনের অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে, সে তথ্য দিয়ে থাকে।

আরও পড়ুন

যুদ্ধ–পরবর্তী মাইন সরানো ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যয়বহুল বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তবে কোথায় কী অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে, তা জানা থাকলে সে এলাকা নিরাপদ করতে কম সম্পদ ব্যয় হয়। এতে মাইন অপসারণকারীর ঝুঁকিও কমে আসে। প্রচলিত সাধারণ ম্যাপ পদ্ধতিতে যুদ্ধ চলাকালে এ ধরনের কাজ করা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু স্কটিশ মানবিক বেসরকারি সংস্থা হ্যালো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার সে কাজটি করে যাচ্ছে। বিস্ফোরণস্থল শনাক্ত করা থেকে শুরু করে ক্লাস্টার বোমার মতো কী ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে এবং দূষণের মাত্রাও বের করছে হ্যালো।

আরও পড়ুন

বার্তা সংস্থা এএফপি বলছে, ইউক্রেনের ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক এলাকাগুলোর ক্ষয়ক্ষতির ম্যাপ তৈরিতেও কাজ চলছে। ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরুর তিন মাসের মধ্যে ইউনেসকোর তালিকাভুক্ত অনেক ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ধ্বংস হয়ে গেছে। সাংস্কৃতিক বিশেষজ্ঞরা উন্নত প্রযুক্তি ও থ্রিডি স্ক্যান ব্যবহার করে এগুলো সংরক্ষণের জন্য কাজ করছেন। স্কাইরন, ব্যাকআপ ইউক্রেন ও পিক্সেলেট রিয়্যালিটিজের মতো প্রতিষ্ঠান ইউক্রেনের ইতিহাস রক্ষায় কাজ করছে। এসব প্রতিষ্ঠান মূলত ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ও বস্তুর থ্রিডি স্ক্যান করে রাখছে। ইতিমধ্যে ইউনেসকো ঘোষণা দিয়েছে, ইউক্রেনের ২২৪টি ঐতিহ্য এলাকার ক্ষতি হয়েছে বা ধ্বংস হয়েছে। যুদ্ধ শেষ হলে এই থ্রিডি স্ক্যান ব্যবহার করে পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার নির্দেশনা দেওয়া যাবে।

বোমায় ক্ষতি হওয়া স্থানগুলোর থ্রিডি ছবি ভবিষ্যতে বিচারের জন্য প্রমাণ হিসেবেও ব্যবহৃত হতে পারে। গত আগস্ট মাসে আর্টেব নামের লুক্সেমবার্গভিত্তিক থ্রিডি প্রোডাক্ট প্রতিষ্ঠান ইউক্রেনের পুলিশ বাহিনীর মানবাধিকার বিভাগের সঙ্গে রুশ সেনাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহে একসঙ্গে কাজের ঘোষণা দেয়।

আরও পড়ুন

তবে ইউক্রেনে প্রযুক্তির ব্যবহার কেবল বোমা হামলার স্থানগুলোতে স্ক্যানিং প্রচেষ্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ইউক্রেনের পুলিশ এমন একটি সফটওয়্যার ব্যবহার করছে, যাতে থাকা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দীর্ঘদিন ধরে বিতর্কিত বলে বিবেচনা করা হচ্ছিল।

নিউইয়র্কভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ক্লিয়ারভিউ এআই তাদের সফটওয়্যার ইউক্রেনকে বিনা মূল্যে ব্যবহারের জন্য দিয়েছে। এতে থাকা চেহারা শনাক্তকরণ প্রযুক্তি (ফেশিয়াল রিকগনিশন সফটওয়্যার) মৃত বা বন্দী রুশ সেনাদের শনাক্ত করতে ব্যবহার করা হচ্ছে।

ইউক্রেনের পক্ষ থেকে নতুন নতুন সব ধরনের প্রযুক্তি পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। একদিকে যেমন ভবনের থ্রিডি প্রযুক্তির ব্যবহার রয়েছে, তেমনি হাসপাতালে ব্যবহারের জন্য স্বয়ংক্রিয় রক্তদান যন্ত্রের ব্যবহারও দেখা যাচ্ছে। ইউক্রেন মূলত চরম পরিস্থিতিতে সর্বশেষ প্রযুক্তিগুলোর পরীক্ষা কেন্দ্র হিসেবে উদ্ভূত হচ্ছে।

তথ্যসূত্র: এএফপি, স্ট্রেইট টাইমস ও ইকোনমিস্ট

আরও পড়ুন