বিদ্রোহের এক বছর, ভাগনার সেনারা কোথায়
এক বছর আগে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল ভাড়াটে সেনা সরবরাহকারী গোষ্ঠী ভাগনার। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ক্ষণস্থায়ী সেই ব্যর্থ বিদ্রোহের পর এক বছরে ভাগনারকে কার্যত অকার্যকর করে দিয়েছে রাশিয়া। গোষ্ঠীটির ভাড়াটে সেনারা থাকলেও ভাগনার আর আগের মতো নেই। তবে বিভিন্ন গোষ্ঠী ও উপগোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে তাঁরা ঠিকই রয়ে গেছেন।
রুশ বাহিনীর পাশাপাশি ইউক্রেনীয় সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন ভাগনারের সেনারা। ২০২৩ সালের ২৩ জুন ভাগনারের প্রয়াত প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিনের নেতৃত্বে ভাড়াটে সেনারা সীমান্ত পার হয়ে রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রোস্তভের দখল নেয়। কয়েক মাস ধরে রাশিয়ার সামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে মতানৈক্য ও সমালোচনা নিয়ে টানাপোড়েনের পর এই বিদ্রোহ করেন প্রিগোশিন।
রোস্তভের দখল নেওয়ার পর ভাগনারের সেনারা রাশিয়ার রাজধানী মস্কো অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। এই যাত্রায় দৃশ্যত কোনো প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়নি তাঁদের। প্রিগোশিন এর নাম দিয়েছিলেন ‘ন্যায়বিচারের যাত্রা’। তবে মস্কো অভিমুখে ভাগনার সেনাদের এই যাত্রার সমাপ্তি ঘটে এক দিনের মাথায়। কারণ, এর আগেই ভাগনারপ্রধান রাজধানী অভিমুখে যাত্রা বাতিল করার সিদ্ধান্তের কথা জানান।
এর মাত্র দুই মাসের মাথায় এক বিমান দুর্ঘটনায় প্রিগোশিন ও ভাগনারের বেশ কয়েকজন শীর্ষ কমান্ডার নিহত হন। এর মধ্য দিয়েই ভাগনারের ভবিষ্যৎ বড় ধরনের এক অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে যায়।
ভাড়াটে সেনাবিষয়ক জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপের সদস্য ও ইউনিভার্সিটি অব কোপেনহেগেনের শিক্ষক ডা. সোরচা ম্যাকলিয়ডের মতে, সাবেক ভাগনার সেনারা রাশিয়াজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন।
সোরচা ম্যাকলিয়ড বিবিসিকে বলেন, ‘অতীতের মতো অবস্থায় হয়তো নেই ভাগনার। কিন্তু এর একটি সংস্করণ অথবা একাধিক সংস্করণ এখনো রয়ে গেছে। রাশিয়াজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার কারণে এর একক কোনো নিয়ন্ত্রক অর্থাৎ প্রধান নেই। ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ভাগনারের অস্তিত্ব রাশিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই অনেকে এই ধরনের কথা বললেও এর অস্তিত্ব কখনো বিলীন হবে না।’
সিরিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে রাশিয়ার হয়ে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রিগোশিনের এই বাহিনী রাশিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। তবে ইউক্রেন যুদ্ধের আগে ভাগনারের বিষয়ে রাশিয়া প্রকাশ্যে কিছুই স্বীকার করত না। যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেনীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে রুশ বাহিনী বাধার মুখে পড়ার পর যোগ দেয় ভাগনার। এর মধ্য দিয়ে ভাগনার প্রকাশ্যে আসে।
২০২২ সালের শেষ দিক থেকে শুরু করে ২০২৩ সালের প্রথম দিকে রাশিয়া রণক্ষেত্রে যেসব বিজয় অর্জন করে, তাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল ভাগনার। মূলত একসময়ের কয়েদিদের নিয়ে গঠিত ভাগনারের সেনারা এই সময়ে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় শহর সোলেদারের নিয়ন্ত্রণ নেন। এরপর ইউক্রেনের আরেক শহর বাখমুত নিয়ে কয়েক মাস যে রক্তক্ষয়ী লড়াই হয়, সেখানেও সামনে ছিল ভাগনার।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী ভাগনারের যখন বাড়বাড়ন্ত, তখন গোষ্ঠীটির প্রায় ৫০ হাজার সেনা ইউক্রেনে যুদ্ধ করছিলেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউক্রেনে এখন ভাগনার সেনারা এককভাবে যুদ্ধ করছেন না। রাশিয়ার সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর সঙ্গে তাঁদের একীভূত করা হয়েছে। বিদ্রোহের পর সামরিক বাহিনীতে একীভূত হওয়ার জন্য তাঁদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
ভাগনারের সাবেক এক কমান্ডার সম্প্রতি বিবিসিকে বলেন, ভাগনারের সেনাদের হয় রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের হয়ে বিভিন্ন বাহিনীতে যোগদান, নয়তো চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল ক্রেমলিন।
ব্রিটিশ গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মতে, ভাগনারের পদাতিক বাহিনীর কিছু ইউনিটকে রাশিয়ার ন্যাশনাল গার্ডের সঙ্গে একীভূত করে নেওয়া হয়েছে। ২০১৬ সালে রোসগভারদিয়া নামে যাত্রা শুরু করে এ বাহিনী। রাশিয়ার ন্যাশনাল গার্ড বা রোসগভারদিয়াকে অনেকে পুতিনের ব্যক্তিগত সেনাবাহিনী বলে বর্ণনা করে থাকেন। এই বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করেন পুতিনের একসময়কার দেহরক্ষী ভিক্টর জোলোতভ।
যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ভাগনার গ্রুপের কোনো কোনো ইউনিটের নিয়ন্ত্রণ ন্যাশনাল গার্ডের অধীনে আসতে শুরু করে। এ একীভূতকরণ স্বেচ্ছায় হয়েছে বলে দাবি করা হয়। ন্যাশনাল গার্ডে একীভূত করে নেওয়া ভাগনারের সেনাদের মূলত ছয় মাসের চুক্তিতে ইউক্রেনে যুদ্ধ করার জন্য এবং নয় মাসের চুক্তিতে আফ্রিকায় নিয়োগ করা হয়।
ন্যাশনাল গার্ডে ভাগনার সেনাদের যোগ দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায় গোষ্ঠীটির দীর্ঘদিনের কমান্ডার আন্তন ইয়েলিজারোভের কথায়। তিনি বাখমুতে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। আন্তন ইয়েলিজারোভ ভাগনারের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি টেলিগ্রাম চ্যানেলে প্রকাশিত ভিডিও চিত্রে বলেন, ন্যাশনাল গার্ডে যোগ দেওয়ার জন্য নতুন ঘাঁটি নির্মাণের সময় তিনিও উপস্থিত ছিলেন।
সম্প্রতি বিবিসির অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভাগনার সেনাদের একটা অংশ যোগ দিয়েছে চেচনিয়ার বাহিনী আখমাতে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলটির নেতা ও পুতিনের মিত্র রমজান কাদিরভ এই বাহিনীর প্রধান।
রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর সেন্ট পিটার্সবার্গে ছিল ভাগনারের প্রধান কার্যালয়। সেখান থেকে সম্প্রতি ভাগনারের লোগো সরিয়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যে গোষ্ঠীটির তৎপরতায় ভাটা পড়ার খবর জানা যাচ্ছে।
ব্যর্থ বিদ্রোহের কয়েক দিন পরই জানা গিয়েছিল, পুতিনের সঙ্গে একটি সমঝোতা করেছেন প্রিগোশিন। সমঝোতা অনুযায়ী প্রিগোশিন ভাগনারের কার্যক্রম আফ্রিকায় সরিয়ে নিতে রাজি হয়েছিলেন।
প্রিগোশিনের মৃত্যুর পরে রাশিয়ার উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী ইউনুস বেক ইয়েভকুরোভকে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ সফর করতে দেখা গিয়েছিল। ভাগনার সেনাদের নিয়োগ নিশ্চিতই ছিল তাঁর সফরের লক্ষ্য। চলতি মাসের শুরুতে চিন্তন প্রতিষ্ঠান পোলিশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স বলেছে, প্রিগোশিনের মৃত্যুর পর রাশিয়ার সরকারের মনোযোগ আফ্রিকায় দুর্বল নয় বরং আরও সংহত হয়েছে।