ইউরোপের ‘হৃৎপিণ্ডে ফুটো’
গল্পটা হয়তো নেহাতই গল্প। তবে গল্পটা দুর্দান্ত লাগসই। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রয়াত হেনরি কিসিঞ্জার নাকি একবার বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘ইউরোপকে ডাকতে চাইলে আমি কাকে বা ডাকাব?’ (অবশ্য কিসিঞ্জার তখন সরকার ছেড়েছেন)। তবে এত দিন কিন্তু এ প্রশ্নের একটি ভালো জবাব ছিল। ১৯৮০ বা ৯০–এর দশকে জবাবটা ছিল জার্মান চ্যান্সেলর হেলমুট কোহল। ২০০৫ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এ প্রশ্নের উত্তর ছিল আঙ্গেলা ম্যার্কেল। বলা হয়ে থাকে, জার্মানি এতটা বড়, ধনী আর ওজনদার যে জার্মানির চ্যান্সেলর না চাইলে ইউরোপে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কিছু ঘটে না। জার্মানির চ্যান্সেলের যা চান, সচরাচর তা পান। কিন্তু সে দৃশ্যপট বদলে গেছে।
ম্যার্কেলের পর জার্মানির চ্যান্সেলর হয়েছেন ওলাফ শলৎজ। গুগল করলে দেখা যায়, এখন জার্মানির নেতা হচ্ছে জনৈক ওলাফ শলৎজ! কিন্তু এতটাই তিনি নিষ্প্রভ ও বিবর্ণ যে তাঁর এ পরিচয় অনেকেই হয়তো জানে না।
যখন ইউরোপের অর্থনীতি স্থবির, প্রায় সর্বত্র জনমত জরিপে কট্টর ডানপন্থীদের এগিয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে বৃষ্টির মতো রকেট ছুড়ছেন, সেখানে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়েও শলৎজ যেন প্রায় অদৃশ্য এক অস্তিত্ব। জার্মানিতে তাঁর রাজনৈতিক দল সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটস জনপ্রিয়তার দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে। তাঁর দলের পক্ষে সমর্থন মাত্র ১৫ শতাংশ, যেন এক পরিহাসের মতো! শলৎজকে বেশির ভাগ সময় কাটাতে হয় তাঁর নাজুক ত্রিমুখী জোটকে টিকিয়ে রাখতেই।
এই হতবিহ্বল অক্ষমতার প্রভাব জার্মানির সীমানা পেরিয়ে অনেক দূর যাচ্ছে। শলৎজের অনুপস্থিতি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে নেতৃত্বহীন করে রেখেছে। জার্মানিকে ইইউয়ের চালক হতে হবে। ইউক্রেনের জন্য অর্থ জোগাড় করা ও অন্যান্য দেশের অভিবাসন সমস্যা সমাধান, পুঁজিবাজার ইউনিয়ন তৈরি, ইউক্রেনকে ইইউ সদস্য করার লক্ষ্যে পদ্ধতিগত সংস্কারে নেতৃত্ব দিতে হবে। এ ছাড়া মাথায় রাখতে হবে, এ বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এতে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জিতে গেলে গেলে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য ইউরোপকে প্রস্তুত রাখতে হবে। কোহল ও ম্যার্কেল এসব চাহিদা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। তাঁরা চরকির মতো দেশ থেকে দেশে যেতেন, আলোচনা–মধ্যস্থতা করতেন। কিন্তু পুরো বিষয়টিই স্বল্পভাষী শলৎজের কাছে একেবারেই নতুন। ইউক্রেনের কট্টর সমর্থক হয়েও তিনি অন্যদের উৎসাহিত করতে ইতিমধ্যে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন।
তবে জার্মানির শক্ত অবস্থানে আসার বিষয়টি পুরোপুরি জার্মান চ্যান্সেলরের ওপর নির্ভর করছে না। এর সঙ্গে ফ্রান্সেরও যুক্ততা রয়েছে। কারণ, ফ্রান্স যত শক্তিশালী হবে, ততই জার্মানিও বলশালী হবে। ওদিকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েছে। ২০২২ সালে তিনি পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা খুইয়েছেন। কোনো আইন পাস করাতে তাঁকে বেগ পেতে হচ্ছে। বিপাকে পড়া ফরাসি প্রেসিডেন্টরা যা করে থাকেন, মাখোঁ সম্প্রতি তাঁর প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী করেছেন ৩৪ বছর বয়সী শিক্ষামন্ত্রী গ্যাব্রিয়েল আত্তলকে। অতীতে সংস্কারের একজন চ্যাম্পিয়ন হিসেবে দেখা হতো মাখোঁকে। কিন্তু আজকাল ইউরোপকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা কমে গেছে তাঁর।
আবার শলৎজ ও মাখোঁর ঘনিষ্ঠ সূত্র বলছে, দুজনের বনিবনা ভালো নয়। এর একটা কারণ হয়তো তাঁদের ব্যক্তিত্ব একেবারেই আলাদা। ইউরোপের মধ্যেই বেশি অর্থ খরচের পক্ষে মাখোঁ। তিনি পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব থেকে দূরে থাকতে চান। অর্থনৈতিক নীতিতে সরকারি নিয়ন্ত্রণ তাঁর পছন্দ। শলৎজ এর কোনোটাই পছন্দ করেন না।
শলৎজের সঙ্গে মাখোঁর মতামতেও কোনো মিল নেই। একসঙ্গে কাজ করার ইচ্ছা থাকলে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য হয়তো কাজে আসতে পারে। কিন্তু তাঁদের একসঙ্গে কাজ করার ইচ্ছা আছে বলে মনে হয় না।
একসময় ফ্রান্স ও জার্মানির শক্তিতে ইউরোপ চলত। কিন্তু তাদের সেই মোটর ভেঙে গেছে। কিন্তু আশার কথা হচ্ছে, কয়েকটি সহায়ক প্রক্রিয়া এখনো কাজ করে যাচ্ছে। এমন সহায়ক শক্তি হচ্ছে ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন। জার্মানির নাগরিক হিসেবে তিনি শলৎজের চেয়ে বেশি কার্যকর। উরসুলা এমন এক নেতা, যিনি সামনের হেমন্তে আবার একই পদে নিয়োগ পাওয়ার যোগ্য। তিনি কোভিড পুনরুদ্ধার তহবিল গঠন ও এর ব্যবহারের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু তাঁর ক্ষমতা সীমিত। তিনি কোনো জ্যাক ডেলরস নন, যিনি ইউরোপকে একক বাজার ও একক মুদ্রার জন্য একজোট করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ইউরোপের জন্য আরেক চালিকা শক্তি হচ্ছেন পোল্যান্ডের নতুন প্রধানমন্ত্রী ও ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক। কিন্তু তাঁকে ঘর সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
এখন জো বাইডেন যদি নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতেও যান, তারপরও ইউরোপের নিরাপত্তাদাতার ভূমিকা থেকে সরে আসতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপকে তার নাগরিকদের নিরাপদ রাখতে অর্থ খরচের পাশাপাশি আরও বাড়তি পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু নতুন এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পরিবর্তে ইউরোপের নেতারা আত্মকেন্দ্রিকই হয়ে থাকছেন।
অনুবাদ: মো. মিন্টু হোসেন