প্রধানমন্ত্রিত্ব রক্ষায় লড়ছেন লিজ ট্রাস
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের দেড় মাসের কম সময়ের মাথায় প্রধানমন্ত্রিত্ব হারানোর শঙ্কায় পড়েছেন লিজ ট্রাস। নিজের গদি বাঁচানোর জন্য ঘনিষ্ট মিত্র ও অর্থমন্ত্রী কাওয়াসি কোয়ারতেংকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছেন তিনি। এতেও পার পাচ্ছেন না ট্রাস। নিজ দলের ভেতরেই তাঁর পদত্যাগের দাবিতে সরব হয়েছেন বেশিরভাগ এমপি।
নির্বাচনী প্রচারে কর ছাড়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ট্রাস। এর ওপর ভর করেই কনজারভেটিভ পার্টির প্রধান ও দেশের প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। কিন্তু ক্ষমতায় এসে সেই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে এসেছেন ট্রাস। মূলত এর জেরেই প্রধানমন্ত্রীর পদ হারানোর ঝুঁকিতে পড়েছেন তিনি।
আমি খুব খুব কঠিন একটি কাজ করতে যাচ্ছি। আমাদের অবশ্যই এই বিষয়ে জনগণের কাছে সৎ থাকতে হবে।জেরেমি হান্ট, যুক্তরাজ্যের অর্থমন্ত্রী
যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে গত শুক্রবার সকালে হঠাৎ ঝড় ওঠে। অর্থমন্ত্রী কাওয়াসি কোয়ারতেং ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের যৌথ বৈঠকে অংশ নিতে সেখানে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বৈঠকের মাঝপথে সফর সংক্ষিপ্ত করে লন্ডনে ফিরতে হয় তাঁকে। সেদিনই তাঁকে বরখাস্ত করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ১০নং ডাউনিং স্ট্রিটে লিজ ট্রাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তিনি। এর পর দায়িত্ব ছাড়ার কথা জানান।
কনজারভেটিভ পার্টির এমপিরা মনে করছেন, দেশের অর্থনীতি এখন যেমন বেসামাল হয়ে রয়েছে, ট্রাস কোনোভাবেই অর্থনৈতিক উত্তরণ ঘটাতে পারবেন না। তাই তাঁর পদত্যাগ করা সবচেয়ে ভালো বিকল্প। এমপিদের কেউ কেউ আগাম নির্বাচন দেওয়ার দাবিও তুলেছেন।
বরখাস্ত হওয়ার তিন সপ্তাহ আগে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে সংক্ষিপ্ত বাজেট ঘোষণা করেন কাওয়াসি কোয়ারতেং। ওই বাজেটে কর ছাড়ের ছড়াছড়ি থাকায় বেশ বিতর্কের জন্ম দেয়। পুঁজিবাজারেও অস্থিরতা শুরু হয়। এক পর্যায়ে মার্কিন ডলারের বিপরীতে যুক্তরাজ্যের মুদ্রা পাউন্ড মূল্যমান হারিয়ে কয়েক দশকের সর্বনিম্ন অবস্থানে চলে যায়। যদিও ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের হস্তক্ষেপ, সংক্ষিপ্ত বাজেট বাতিলের গুঞ্জন ও অর্থমন্ত্রীকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে— এমন খবরে বাজারের কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরে আসে।
অবশেষে সেই গুঞ্জন সত্যি হয়। অর্থমন্ত্রী কাওয়াসি কোয়ারতেংকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেন ট্রাস। তবে এর মধ্য দিয়ে ট্রাসের বিপদ কেটে গেছে— এমনটা ভাবার অবকাশ নেই। কোয়ারতেং দায়িত্ব থেকে সরে গেছেন মানেই যে ট্রাস বিপদমুক্ত এমনটা কিন্তু নয়। কেননা ট্রাসের কর ছাড়ের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন দেখা গিয়েছিল ওই বাজেটে। কিন্তু এখন ধীরে ধীরে সেই অবস্থান থেকে সরে আসছেন ট্রাস। এজন্য সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেরেমি হান্টকে অর্থমন্ত্রী করেছেন তিনি।
আগামী কয়েকদিন ট্রাসের সামনে কঠিন সময়। তাঁকে বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে। প্রথমত, মুদ্রাবাজার কেমন আচরণ করছে সেটা বড় একটি বিষয় হিসেবে দেখা দেবে। দ্বিতীয়ত, ট্রাসকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দিতে সহকর্মীদের উদ্যোগ কতটা সফল হয় সেটার মুখোমুখি হতে হবে তাঁকে।
এই পরিস্থিতিতে কনজারভেটিভ পার্টির এমপিরা মনে করছেন, দেশের অর্থনীতি এখন যেমন বেসামাল হয়ে রয়েছে, ট্রাস কোনোভাবেই অর্থনৈতিক উত্তরণ ঘটাতে পারবেন না। তাই তাঁর পদত্যাগ করা সবচেয়ে ভালো বিকল্প। এমপিদের কেউ কেউ আগাম নির্বাচন দেওয়ার দাবিও তুলেছেন। এমপিদের অনেকে মনে করছেন, ট্রাসকে সরিয়ে দিয়ে সাবেক অর্থমন্ত্রী ঋষি সুনাককে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হোক। ট্রাসের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত টিকে ছিলেন সুনাক।
দেশে–বিদেশে সমালোচনার মুখে গত রোববার ট্রাস ডেইলি সান–এ একটি নিবন্ধ লিখেছেন। এতে তিনি বলেছেন, ‘বাজারের ওপর আস্থা না রেখে আমরা কর ছাড়, উচ্চ প্রবৃদ্ধির অর্থনীতির পথে এগোতে পারি না।’ তাঁর এমন বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, ট্রাস এখন দুটি বিষয়ের মধ্যে ভারসাম্য ধরে রাখার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রথমটি, বাজারের আস্থা ধরে রাখা। দ্বিতীয়টি, নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের পতন ঠেকানো। এখন সময়ই বলে দেবে দিন শেষে ট্রাস কোনটি রক্ষা করতে পারেন।
এই বিষয়ে আল–জাজিরার লন্ডন প্রতিনিধি অ্যান্ড্রু সাইমনস বলেন, কনজারভেটিভ পার্টি ট্রাসের বিকল্প হিসেবে অন্য আরেকজন নেতা খুঁজছেন, এটা নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হল, সেই নেতা কী একটি সাধারণ নির্বাচনের চাপ সামলাতে পারবেন কিনা।
এদিকে নতুন বাজেট প্রস্তাবনা নিয়ে চাপের মধ্যে রয়েছেন নবনিযুক্ত অর্থমন্ত্রী জেরেমি হান্টও। বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, আমি খুব খুব কঠিন একটি কাজ করতে যাচ্ছি। আমাদের অবশ্যই এই বিষয়ে জনগণের কাছে সৎ থাকতে হবে।
এসবের মধ্যে ট্রাসের বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোট আনতে কনজারভেটিভ পার্টির শতাধিক এমপি চিঠি দিয়েছেন বলে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি বিরোধীরাও সরব হয়ে উঠেছে ট্রাসের পদত্যাগের দাবিতে। এদিকে ঋষি সুনাক দলের নেতা ও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য তোরজোর শুরু করেছেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেসকে সম্ভাব্য বিকল্প প্রার্থী হিসেবে ভাবা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার লড়াইয়ে সুনাককে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন কনজারভেটিভ এমপি রবার্ট হালফন। ট্রাসের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘কয়েক সপ্তাহ ধরে সরকার পুরো জাতির সঙ্গে গবেষণাগারে থাকা ইঁদুরের মতো আচরণ করেছে। বাজার নিয়ে নিরীক্ষা করেছে। এটা নিয়ে আমি ভীষণ উদ্বিগ্ন।’
তিনি আরও বলেন, ‘লিজ ট্রাসের এমন আচরণে সহকর্মীরা বেশ অসন্তুষ্ট। জনমত জরিপেও এর প্রভাব দেখা গেছে। তাই সহকর্মীরা নিজে থেকেই বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে উদ্যোগী হয়ে উঠেছেন। তাঁরা কিছু একটা করতে চাইছেন।’
আগামী কয়েকদিন ট্রাসের সামনে কটিন সময়। তাঁকে বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে। প্রথমত, মুদ্রাবাজার কেমন আচরণ করছে সেটা বড় একটি বিষয় হিসেবে দেখা দেবে। দ্বিতীয়ত, ট্রাসকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দিতে সহকর্মীদের উদ্যোগ কতটা সফল হয় সেটার মুখোমুখি হতে হবে তাঁকে।
বিশ্লেষকদের অনেকের মতে, শুধুমাত্র এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলেই টিকে যাবে ট্রাসের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার। নাহলে কয়েক সপ্তাহের প্রধানমন্ত্রিত্বের স্বাদ নিয়েই বিদায় নিতে হবে যুক্তরাজ্যের তৃতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী ট্রাসকে।
দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি ও আল–জাজিরা অবলম্বনে