রুশ ‘ইলন মাস্ক’ দুরভ ১০০ সন্তানের বাবা

টেলিগ্রামের প্রধান নির্বাহী পাভেল দুরভ
ছবি : রয়টার্স

পাভেল দুরভ অনেক লোকের কাছে অনেক কিছু। কারও কাছে তিনি প্রোগ্রামিং দুনিয়ার বিস্ময় তো কারও কাছে বিলিয়নিয়ার উদ্যোক্তা। কেউ তাঁকে ভাবেন ক্রেমলিনের পুতুল, কেউবা বাক্‌স্বাধীনতার যোদ্ধা। এই পাভেল দুরভের সঙ্গে অন্তত ১০০ শিশুর জিনগত সম্পর্ক রয়েছে। অর্থাৎ জৈবিক দিক বিচারে তিনি ১০০ সন্তানের বাবা।


দুরভের বড় পরিচয়, তিনি বার্তা আদান–প্রদানের অ্যাপ টেলিগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা। গত সপ্তাহে ব্যক্তিগত উড়োজাহাজে করে ফ্রান্স সফরের সময় তাঁকে আটক করা হয়েছে। তাঁকে মেটা ও ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গের মতো অসাধারণ বিবেচনা করা হয়। একই সঙ্গে বর্তমান এক্স (সাবেক টুইটার) প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক ডরসির অদ্ভুত জীবনযাপনের সঙ্গে তাঁর মিল পাওয়া যায়।

টেসলার প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্কের স্বাধীনচেতা হওয়ার বৈশিষ্ট্যও রয়েছে দুরভের মধ্যে। ইলন মাস্কের যেমন অনেক সন্তান জন্ম দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়, সেটি দুরভের মধ্যেও রয়েছে। ১৫ বছর ধরে শুক্রাণু দান করে আসছেন দুরভ। গত জুলাইয়ে। তিনি স্বীকার করেন, তাঁর শুক্রাণু থেকে ১০০ সন্তান জন্ম নিয়েছে।

ব্লুমবার্গের তথ্য অনুযায়ী, পাভেল দুরভের মোট সম্পদের পরিমাণ ৯১৫ কোটি মার্কিন ডলার। তাঁর অনেক দেশের পাসপোর্ট ও আবাস রয়েছে। এক দশকের বেশি সময় ধরে তিনি সীমানাহীন এক জীবন যাপন করছেন। তাঁকে প্রায়ই খালি গায়ে বিভিন্ন দেশে ভ্রমণে যেতে দেখা যায়। গণতান্ত্রিক হোক আর অন্য যেকোনো দেশের সরকারি বিভিন্ন সংস্কার নজরদারি এড়িয়ে মুক্ত যোগাযোগের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন তিনি।

তবে দুরভকে আটকের বিষয়টি এখন নতুন একটি বিতর্ক তৈরি করছে। তাঁর তৈরি টেলিগ্রাম অ্যাপ এন্ড টু এন্ড এনক্রিপশন প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের মধ্যে নিরাপদ যোগাযোগের সুবিধা দেয়। এতে তৃতীয় পক্ষ ঢুকতে পারে না। ধারণা করা হচ্ছে, দুরভকে আটকে টেলিগ্রামের এনক্রিপশন প্রযুক্তিতে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করা হতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আয়ত্তে আনার জন্য যে চেষ্টা চালাচ্ছে, দুরভকে আটক করে বিষয়টি হাসিলের চেষ্টা করা হতে পারে।

এ বছরের শুরুতে ডানপন্থী বিশেষজ্ঞ টাকার কার্লসনকে এক সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন দুরভ। এ প্রযুক্তি উদ্যোক্তা নিজের সম্পর্কে বলেন, ১৯৮৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে তাঁর জন্ম। চার বছর বয়সে তাঁর পরিবার ইতালি চলে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর তাঁর পরিবার রাশিয়ায় ফিরে আসে। তখন দুরভের বাবা সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টেট ইউনিভার্সিটিতে কাজের সুযোগ পান।

দুরভ বলেন, তিনি ও তাঁর বড় ভাই নিকোলাই ছোট বয়স থেকেই গণিতে খুব ভালো ছিলেন। তবে ছোট হলেও তিনিই ছিলেন তারকা। তবে তাঁর ভাই ইতালির টেলিভিশনে গণিত প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পান। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডেও তিনি পুরস্কার পান। তবে দুরভ তাঁর স্কুল ও এলাকায় সেরা ছাত্র ছিলেন।
 

দুরভ বলেন, ‘আমরা দুজনেই কোড ও নকশা তৈরির ক্ষেত্রে খুবই আন্তরিক ছিলাম। তিনি বলেন, তাঁর পরিবার রাশিয়াতে ফেরার সময় আইবিএম পিসি এক্সটি কম্পিউটার এনেছিল। ওই সময় খুব কম রুশ পরিবারে প্রোগ্রামিং শেখার সুযোগ ছিল।

ইলন মাস্কের সঙ্গে তুলনা করা হয় পাভেল দুরভকে।
ছবি : রয়টার্স

দুরভের কোডিং সক্ষমতা ও উদ্যোক্তা হওয়ার স্পৃহা তাঁকে ভিকোনটাকটে (ভিকে) নামের একটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তৈরিতে উৎসাহ দেয়। ২১ বছর বয়সে ২০০৬ সালে তিনি ভিকে তৈরি করেন। অল্প সময়ে রাশিয়ার ফেসবুক হিসেবে পরিচিত পায় ভিকে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গের সমকক্ষ হিসেবে রাশিয়ায় পরিচিত পান দুরভ।

কিন্তু ক্রেমলিনের সঙ্গে দুরভের সম্পর্ক খুব দ্রুত খারাপ হতে শুরু করে। ইউক্রেনের কিয়েভের বিক্ষোভকারীরা ভিকে ব্যবহার করে রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইভানোভিচের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করেন। দুরভ বলেন, ২০১৩ সালের ওই সময়ে ক্রেমলিন তাঁকে ইউক্রেনীয় ব৵বহারকারীদের তথ্য তাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য চাপ দেয়।

কার্লসনকে দুরভ বলেন, ‘আমরা তা প্রত্যাখ্যান করি। এতে রুশ সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হয়।’


দুরভের ওই সিদ্ধান্ত কোম্পানির ভাগ্য বদলে দেয়। দুরভ ভিকের সিইও পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য হন। ওই পদে আসেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ঘনিষ্ঠ লোক। দুরভ তখন ভিকের সব শেয়ার বিক্রি করে রাশিয়া ছেড়ে যান। বর্তমানে ভিকে রুশ সরকারের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়।

দুরভ বলেন, ‘আমি কখনো ধনী হতে চাইনি। আমার জীবনের সবকিছু ছিল মুক্ত ও স্বাধীন থাকা। এ লক্ষ্য থেকে আমার মিশন হয়ে দাঁড়ায় অন্য ব্যক্তিদেরও মুক্ত বা স্বাধীনতার স্বাদ দেওয়া। তিনি বলেন, ‘আমি কারও কাছ থেকে আদেশ গ্রহণ করতে চাই না।’

‘ওগুলো সব বাজে’

সিগন্যাল, টেলিগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপের লোগো
কোলাজ


বর্তমানে মেটা নামে পরিচিত সামাজিক মাধ্যমের সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে জাকারবার্গ যখন হোয়াটসঅ্যাপ কেনেন, তখন নিজের বার্তা আদান–প্রদানের অ্যাপ চালু করার সিদ্ধান্ত নেন দুরভ। ওই সময় এ ধরনের অনেক অ্যাপ বাজারে চালু ছিল। তবে যেগুলো চালু ছিল, সেগুলো তার কাছে যথেষ্ট ছিল না। ২০১৫ সালে প্রযুক্তিবিষয়ক ওয়েবসাইট টেকক্রাঞ্চকে দুরভ বলেন, ‘বাজারে কত বার্তা আদান–প্রদানের অ্যাপ আছে, সেটি বিষয় নয়; কারণ, ওইগুলো সবই বাজে।’

দুরভ আরও বলেন, টেলিগ্রাম তৈরির পেছনে ক্রেমলিনের অভিজ্ঞতা উদ্দীপক হিসেবে কাজ করেছে। পরে তিনি দুবাইভিত্তিক অ্যাপ হিসেবে টেলিগ্রাম চালু করেন। তিনি ও তাঁর ভাই মিলে সরকারি শিকারি চোখের আড়ালে থাকবে এমন অ্যাপ তৈরি করতে চেয়েছিলেন।

টেলিগ্রামের শক্তিশালী এনক্রিপশন প্রযুক্তি ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তার নীতিমালার কারণে শুরু থেকেই লাখো মানুষ টেলিগ্রামে যুক্ত হয়। তবে একই সঙ্গে টেলিগ্রাম দুর্বৃত্তদেরও টেনে আনে। এর মধ্যে ২০১৫ সালের নভেম্বের প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে যুক্ত সন্ত্রাসীরাও টেলিগ্রাম ব্যবহার করেই তাদের যোগাযোগ করেছিল বলে অভিযোগ ওঠে।

দুরভ এর আগে অনেকটাই লোকচক্ষুর আড়ালে থাকলেও এ ঘটনার পর থেকে তিনি বাইরে এসে প্রচার শুরু করেন। তিনি বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেন। তিনি সিএনএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, টেলিগ্রাম সন্ত্রাসীদের কোনো আখড়া নয়।
দুরভ দাবি করেন, বর্তমানে বাজারে থাকা যোগাযোগের অ্যাপগুলোর মধ্যে টেলিগ্রাম সবচেয়ে নিরাপদ। এই অ্যাপ থেকে সরকারকে পেছন দরজা দিয়ে তথ্য দিলে এর প্রতি জনগণের আস্থা কমবে ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষায় টেলিগ্রামের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হবে।

২০১৬ সালে দুরভ সিএনএকে বলেন, আপনি একে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ও সরকারের জন্য খুলে দিয়ে নিরাপদ করতে পারবেন না। এটি হতে হবে হয় নিরাপদ, নয় অনিরাপদ।

ক্রেমলিনের প্রশ্ন
সরকারি অনুরোধে সাড়া না দেওয়ায় বিভিন্ন দেশের সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে অ্যাপটি। এ তালিকায় সবার ওপরে রয়েছে রাশিয়া। ২০১৮ সালে এনক্রিপশন ভাঙার সুবিধা প্রত্যাখ্যান করায় মস্কো টেলিগ্রামকে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ দিয়েছিল। নিষেধাজ্ঞার হুমকিতেও টলেননি দুরভ। ২০২০ সালে ওই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।

ভ্লাদিমির পুতিন

এর পরের কয়েক বছরে নিষেধাজ্ঞাহীনভাবে রাশিয়ায় চালু থাকা কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একটি হয়ে দাঁড়ায় এটি। এখন এটি রুশ সরকারের অনেক বিভাগের স্বীকৃত যোগাযোগ চ্যানেল।

দুরভের সমালোচকদের অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে প্রশ্ন তুলে আসছেন। তাঁরা প্রশ্ন তুলছেন, ক্রেমলিনকে ছাড় না দিয়ে কীভাবে টেলিগ্রাম এভাবে বাধাহীন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে? তবে দুরভ এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি ২০১০ সালে রাশিয়ার সঙ্গে ঝগড়া করে দেশ ছাড়ার উদাহরণ দেন।

প্যারিসে আটক হওয়ার আগে দুরভ আজারবাইজান গিয়েছিলেন। প্রায় একই সময় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও দুই দিনের সফরে সেখানে যান। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ অবশ্য বলেন, দুজনের সাক্ষাৎ হয়নি।

দুরভ যদিও জনসম্মুখে রাশিয়া বিমুখ হওয়ার বিষয়টি দেখান, তারপরও প্যারিসে তাঁকে আটকের ঘটনায় রুশ সরকার দুরভের পক্ষে কাজ শুরু করে দিয়েছে। রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেন, প্যারিসে রুশ দূতাবাস দুরভের আইনি সমস্যা কথা জেনেই দ্রুত কাজ শুরু করে দিয়েছে।

অর্থ ও মাদক পাচারকারী এবং শিশুর প্রতি যৌন সহিংসতা ছড়ানো ব্যক্তিদের দ্বারা টেলিগ্রামের অপব্যবহারের বিষয়টি পশ্চিমা সরকারগুলোকে অস্থির করে তুলেছে।
সিএনএন-অধিভুক্ত বিএফএমটিভি জানিয়েছে, দুরভকে আটকের সঙ্গে রাজনৈতিক যোগসূত্র নেই। টেলিগ্রামে কনটেন্ট মডারেশন (আধেয় মডারেশন বা ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি) সংক্রান্ত একটি পরোয়ানা থাকায় তাঁকে আটক করা হয়েছে।

এ ঘটনায় টেলিগ্রামের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, একটি প্ল্যাটফর্ম বা তার মালিককে সেই প্ল্যাটফর্মের অপব্যবহারের জন্য দায়ী বলে দাবি করা অযৌক্তিক। টেলিগ্রাম ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের আইন মেনে চলে। এ ছাড়া দুরভের লুকানোর কিছু নেই।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন