প্রধানমন্ত্রী হিসেবে লিজ ট্রাসের সামনে ৫ চ্যালেঞ্জ

যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির নতুন নেতা লিজ ট্রাস দেশটির পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন
ছবি: এএফপি

যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির নতুন নেতা নির্বাচিত হয়েছেন লিজ ট্রাস। ক্ষমতাসীন দলের প্রধান হিসেবে তিনি এখন দেশটির পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন। অনেকটা যুদ্ধোত্তর নেতার মতো ট্রাস নজিরবিহীন বিভিন্ন ধরনের নীতিগত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবেন বলে মনে করা হচ্ছে।

নতুন প্রধানমন্ত্রীকে জ্বালানিসংকট ও জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধি থেকে শুরু করে দলীয় ও আন্তর্জাতিক নানা ইস্যু সামাল দিতে হবে। নতুন প্রধানমন্ত্রীর সামনে মূল চ্যালেঞ্জগুলো কী হতে পারে—এ নিয়ে একটি বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে দ্য গার্ডিয়ান।

জ্বালানির মূল্য ও জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধি

ট্রাস কীভাবে জ্বালানির মূল্য ও জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধি সামাল দেবেন, সেটাই ঠিক করে দেবে তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্ব এবং আসছে বছরগুলোয় যুক্তরাজ্যের ভাগ্যে কী আছে। জনগণ এর জবাব খুব দ্রুতই চায়।

আরও পড়ুন

টরিদের নেতৃত্বের লড়াইয়ে ট্রাস তাঁর প্রচারণায় অব্যাহতভাবে কর কমানোর বিষয়ে জোর দিয়েছেন। তবে সরাসরি অর্থসহায়তার সুফল নিয়ে তিনি সন্দিহান। দেশটিতে জ্বালানির মূল্য এত দ্রুত বাড়ছে যে লাখো পরিবার তা শোধ করতে পারবে না।

সংকটের মাত্রা বিবেচনায় সমালোচকেরা বলছেন, রাজনৈতিকভাবে এবং নৈতিকভাবে এটা সমর্থনযোগ্য নয়। আরও সহায়তার বিষয়টি নাকচ না করার বিষয়ে ট্রাস সতর্ক ছিলেন। সম্ভবত সবচেয়ে বড় যে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত তাঁকে নিতে হবে, সেটা হলো তিনি কতটা কার্যকর ও সার্বিকভাবে মানুষকে সহায়তার বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছেন।

ট্রাস সাহসী এবং ব্যয়বহুল সিদ্ধান্ত নিলে মুক্তবাজার–ব্যবস্থা এবং টরি এমপি ও সদস্যরা যাঁরা তাঁকে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে পাঠিয়েছেন, তাঁদের বিরাগভাজন হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বেন। আবার খুব সামান্য যদি কিছু করেন, তাহলে যুক্তরাজ্য অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক জরুরি অবস্থার ঝুঁকিতে পড়তে পারে। পরিশোধ–অযোগ্য জ্বালানি বিলের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে, দারিদ্র্যের ব্যাপকতা বাড়বে এবং শীতে কয়েক হাজার বাড়তি মৃত্যু দেখতে হবে।

দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ট্রাস যে জটিলতার মুখে পড়ছেন, সেটা নিয়ে বাড়িয়ে কিছু বলা কঠিনই। সরকার সম্ভবত এলাকা ও সময়ভিত্তিক জ্বালানি ব্যবস্থাপনা ও লোডশেডিং দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। সম্ভাব্য দাঙ্গা ও ব্যাপকতর গণ-অসন্তোষ মোকাবিলায় পুলিশ প্রধানেরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।

জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক সেবা

দারিদ্র্য ও স্বাস্থ্য নিয়ে যাঁরা কাজ করে আসছেন, তাঁরা যুক্তি দিতে পারেন জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক সেবার বিষয়টিও।

জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধি সংকটের অনেক কারণের একটি। বিপুলসংখ্যক মানুষের শীতে জমে যাওয়া বাড়িতে বসবাস এবং খাবার কমাতে বাধ্য হওয়ার মতো সম্ভাব্য পরিস্থিতি বিবেচনায় তাঁরা এমনটা ধারণা করছেন। এতে ইতিমধ্যে ধুঁকতে থাকা স্বাস্থ্য পরিষেবায় চাপ আরও বাড়বে।

যুক্তরাজ্যে সেপ্টেম্বরের শুরুতে দায়িত্ব নেওয়া অধিকাংশ প্রধানমন্ত্রীকে জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার (এনএইচএস) সম্ভাব্য সংকট মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে হয়। ট্রাস ইতিমধ্যে একটির সামনে পড়েছেন। হাসপাতালে শয্যাস্বল্পতার মধ্যেই নিয়মিতভাবে দেরিতে সাড়া দিচ্ছে অ্যাম্বুলেন্স। পুরো প্রক্রিয়া ও কার্যক্রমে রয়েছে দীর্ঘসূত্রতা। অবশ্য এসবের অনেক কিছুই হয়েছে করোনাভাইরাস মহামারির প্রভাবে।

বয়োজ্যেষ্ঠদের সামাজিক সেবার অব্যাহত দুরবস্থার মধ্যে অ্যাম্বুলেন্সের বিলম্ব একটি দিক। হাসপাতালের অধিকাংশ শয্যা তাঁদের দখলে। ভঙ্গুর স্বাস্থ্যের এই রোগীদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন জাতীয় বিমার বর্ধিত অর্থ দিয়ে সামাজিক সেবা খাতে পরিবর্তন আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

কনজারভেটিভ পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ করা

ট্রাসের আগের তিন টরি নেতাই তাঁদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পদত্যাগ করেন কিংবা সরে যেতে বাধ্য হন। এটা চলমান একটি সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এটা এমন একটি সমস্যা, যা অন্য নেতাদের চেয়ে ট্রাসকে আরও কঠিনভাবে মোকাবিলা করতে হবে।

টরি সদস্যদের কাছে ট্রাসের আদর্শিক পরিচয়টা হলো তিনি নিজস্ব স্টাইলে যুক্তরাজ্যের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের উত্তরসূরি, ব্রেক্সিট ইস্যুতে অনমনীয় এবং সাংস্কৃতিক যুদ্ধে বিভক্তির লাইনে হাঁটতে আগ্রহী। নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় এটা ভালো কাজে দিয়েছে। সদস্যদের চেয়ে অনেক কনজারভেটিভ এমপি তুলনামূলক কম ডানপন্থী। এমনকি অধিকতর উদারপন্থার কিছু বিষয় অনুসরণ করেন।

নেতৃত্বের প্রতিযোগিতার প্রথম পর্যায়ে এক-তৃতীয়াংশেরও কম সহকর্মী এমপির সমর্থন পেয়েছিলেন ট্রাস। অনেকেই তাঁর মতাদর্শ ও সক্ষমতা নিয়ে সন্দিহান রয়েছেন। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রিসভা গঠনই হবে তাঁর জন্য গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা।

পার্টির বিভিন্ন শাখা থেকে মন্ত্রিত্ব দেওয়া হলে এমপিদের এক হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। এতে খুব সম্ভবত তাঁর একচোখা রাজনীতির বদনাম ঘুচবে। অবশ্য শীর্ষস্থানীয় পদে উঠে আসতে না পারলে এতে ট্রাসের অনুসারীরা স্বাভাবিকভাবেই নাখোশ হবেন।

নেতৃত্বের লড়াইয়ে তিক্ততার বিষয়টিও থাকছে। ট্রাসের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে ছিলেন প্রতিদ্বন্দ্বী ঋষি সুনাক। ট্রাসের সরকারে কোনো ধরনের দায়িত্ব পালনের বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছেন তিনি।

এ কারণে অসন্তুষ্ট এমপিদের নেতা হয়ে উঠতে পারেন সুনাক। এসব এমপি যেকোনো দুর্ঘটনা বা ভুলের সুযোগ নিতে পারেন। এ ছাড়া পর্যাপ্ত টরি এমপির সমর্থন না পেলে পার্লামেন্টেও তাঁকে কঠিন সময় পার করতে হবে।

ইউক্রেন

জ্বালানি ও জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্য পরিষেবার মতো নীতিগত দুটি বিষয়ের মতো ইউক্রেন ইস্যুতে নিজের বিকল্পগুলো নিয়ে ট্রাসকে অনেক বেশি সময় চিন্তাভাবনা করতে হবে না। বরিস জনসনের সময় তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে আসছেন। রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের প্রতি দৃঢ় সমর্থন অব্যাহত রাখবেন ট্রাস। নিজের দায়িত্ব পালনের শুরুর দিকের সপ্তাহগুলোতে কিয়েভে ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে তাঁর ছবি দেখা যেতে পারে।

তবে অন্যান্য বিশ্বনেতার মতো যুদ্ধ যত সামনে গড়াবে, ট্রাসও জটিলতার মুখোমুখি হবেন। কারণ, এই সংঘাত সমাধানের কোনো ইঙ্গিত মিলছে না। বিশেষ করে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির পরিণতির প্রভাব পড়তে শুরু করবে। বিষয়টি অনেকাংশেই যুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

ট্রাস নিঃসন্দেহে ইউক্রেনের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবেন। কিন্তু এর পরিণতি যেভাবে অনুভূত হচ্ছে, মনে হচ্ছে বিকল্প পরিকল্পনার জন্য সম্ভবত তিনি কনজারভেটিভ পার্টির মধ্য থেকে এবং আরও ব্যাপক পর্যায়ে অধিকতর চাপের মুখে পড়বেন।

নির্বাচন হবে কি না

নীতিগত দিক থেকে যে পরিমাণ কর্মযজ্ঞ ট্রাসকে মোকাবিলা করতে হবে, তা অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। কিন্তু তৃতীয় অন্তর্বর্তী টরি প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে ট্রাস যদি আরও বেশি কিছু হতে চান, তাহলে এটা বিবেচনায় আনা গুরুত্বপূর্ণ।

ট্রাসের টিমের দাপ্তরিক যে অবস্থান, সেটা হলো বর্তমান মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে কোনো নির্বাচন নয়। সে ক্ষেত্রে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর অথবা ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচন হতে পারে। তবে জনসনের ২০১৯ সালের ম্যান্ডেটের ওপর ভিত্তি করে ট্রাস আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ হাউস অব লর্ডসে জটিলতার মধ্যে পড়তে পারেন। এটি পৃথক পলিসি প্ল্যাটফর্ম হিসেবেই দাঁড়িয়ে আছে।

জ্বালানিসংকটের কারণে নির্বাচনের তেমন সম্ভাবনা নাও থাকতে পারে। তবে ট্রাস যদি কোন ধরনের জনপ্রিয়তায় উল্লম্ফন দেখতে চান, অথবা অর্থনীতিতে কিছু সময়ের জন্য স্বস্তি ফেরাতে পারেন, তাহলে নির্বাচন দেওয়ার লোভ সামলানো কঠিনও হতে পারে।

গত দুই দশকের মধ্যে যুক্তরাজ্যের রাজনীতি একটি শিক্ষণীয় বিষয় ২০০৮ সালের বসন্তকাল গর্ডন ব্রাউনের নির্বাচন আয়োজনের ব্যর্থতা। ওই সময় নির্বাচন দেওয়াটা অনুকূল ছিল এবং অনেকটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই তাঁর লড়তে পারার গুঞ্জন ছিল। কিন্তু তিনি এটা না করে নির্বাচন বিলম্বিত করেন। মেয়াদের শেষ নাগাদ পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করেন এবং ওই নির্বাচনে তিনি হেরেছিলেন।