রাশিয়ার ‘সস্তার তেল’ বেশি করে কিনছে চীন
রাশিয়া থেকে এখন বেশি করে তেল কিনছে চীন। রীতিমতো দর-কষাকষি করে চুপিসারে দেশটি থেকে চীন তেল কেনা বাড়িয়ে দিয়েছে। জাহাজের তথ্য ও তেল ব্যবসায়ীদের বরাতে এ খবর জানাচ্ছে রয়টার্স। বলা হচ্ছে, ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর হামলা শুরুর পর রাশিয়া থেকে পশ্চিমা ক্রেতারা তেল কেনা বন্ধ বা কমিয়ে দেওয়ায় যে শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে, তা পূরণ করছে বেইজিং।
রাশিয়া থেকে চীনের তেল আমদানি বাড়ানোর বিষয়টি বিশেষ কারণে উল্লেখযোগ্য। কারণ, এক মাস আগে বিশ্বের সর্ববৃহৎ তেল আমদানিকারক চীন প্রাথমিকভাবে রাশিয়া থেকে তেল কেনা কমিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। রয়টার্স বলছে, ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর মস্কোকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেওয়া ও রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানিগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞার ভয়ে এ ঘোষণা দেয় বেইজিং।
তেল ও গ্যাসের তথ্য বিশ্লেষণ করে এমন একটি প্রতিষ্ঠান ভোরটেক্সার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি মে মাসে রাশিয়া থেকে চীনের তেল আমদানির রেকর্ড হয়েছে। এ মাসে প্রতিদিন রাশিয়া থেকে প্রায় ১১ লাখ ব্যারেল তেল আমদানি করেছে চীন। অথচ এ বছরের প্রথম তিন মাসে গড়ে প্রতিদিন সাড়ে ৭ লাখ ও গত বছর গড়ে রাশিয়া থেকে ৮ লাখ ব্যারেল তেল আমদানি করেছিল।
জাহাজের তথ্যের বরাতে রয়টার্স জানিয়েছে, এ সময়ে রাশিয়া থেকে তেল কিনেছে চীনের ইউনিপেক ও ঝেনহুয়া অয়েল। ইউনিপেক হলো এশিয়ার সর্ববৃহৎ তেল পরিশোধনকারী কোম্পানি সিনোপেক করপোরেশনের বাণিজ্যিক শাখা। আর ঝেনহুয়া চীনের প্রতিরক্ষা বাহিনীর কোম্পানি নরিনকোর অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ ছাড়া সম্প্রতি রাশিয়া থেকে চীনে তেলের বড় সরবরাহকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে হংকংয়ে নিবন্ধিত লিভনা শিপিং লিমিটেড।
রাশিয়া থেকে তেল আমদানি ও সরবরাহের সঙ্গে জড়িত তিন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে রয়টার্স। এর মধ্যে সিনোপেক কথা বলতে চায়নি এবং ঝেনহুয়া ও লিভনা কোনো সাড়া দেয়নি।
রুশ বাহিনী ইউক্রেনে হামলা করার পরপরই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও তেলের বড় কিছু ক্রেতা রাশিয়া থেকে তেল আমদানি নিষিদ্ধ করে। এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) মস্কোর ওপর আরও কিছু নিষেধাজ্ঞা চূড়ান্ত করেছে। এর মধ্যে রাশিয়ার তেলা কেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ইউরোপের তেল পরিশোধনকারী কিছু কোম্পানিও এরই মধ্যে রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করে দিয়েছে। নিষেধাজ্ঞা ও নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরির ভয়ে এমন পদক্ষেপ নিয়েছে এসব কোম্পানি।
ভোগ্যপণ্য বাণিজ্যে বিশ্বের সর্ববৃহৎ দুই প্রতিষ্ঠান ভিটোল ও ট্রাফিগুরা রাশিয়ার সবচেয়ে বড় তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রোসনেফট থেকে তেল কেনা বন্ধ করে দিয়েছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) একটি নিয়ম জারি করেছে, যা ১৫ মে কার্যকর হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ইইউভুক্ত দেশগুলোর চাহিদার মেটানোর জন্য জরুরি নয় এমন ক্ষেত্রে রাশিয়ার তেল উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে তেল কেনা যাবে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চীনের এক ব্যবসায়ী রয়টার্সকে বলেন, ‘ভিটোল ও ট্রাফিগুরা রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করে দেওয়ার পর বড় একটি শূন্যস্থান তৈরি হয়। এতে করে পরিস্থিতি নাটকীয় মোড় নিতে শুরু করে। সেই শূন্যস্থান শুধু এমন কিছু কোম্পানি পূরণ করতে পারে, যাদের সামর্থ্য আছে এবং রাশিয়ার তেল রপ্তানিকারকের সেসব কোম্পানির ওপর আস্থা রাখতে পারে।’
ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রুশ বাহিনীর ইউক্রেনে হামলা শুরুর আগের তুলনায় ব্যারেলপ্রতি প্রায় ২৯ ডলার কমে রাশিয়ার তেল পাচ্ছেন ক্রেতারা। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের তেলের চেয়ে যা অনেক কম। চীনের তেল পরিশোধনকারী কোম্পানির জন্য এটা শাপেবর হয়েছে। কারণ, অর্থনীতির শ্লথগতির কারণে চীনের এসব কোম্পানির মুনাফা কমছিল।
সমুদ্রপথে আমদানি ছাড়াও সরকারি চুক্তি অনুযায়ী, পাইপলাইনের মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় ৮ লাখ ব্যারেল রাশিয়ার তেল পাচ্ছে চীন। অর্থাৎ মে মাসে গড়ে প্রতিদিন রাশিয়া থেকে ২০ লাখ ব্যারেল তেল আমদানি করেছে চীন। চীনের মোট তেলের চাহিদার যা ১৫ শতাংশ। এদিকে নিষেধাজ্ঞার কারণে ধুঁকতে থাকা রাশিয়ার অর্থনীতির চাকা ঠিক রাখতে তেল বিক্রির অর্থ বড় ভূমিকা রাখছে।
সিনোপেক ও ঝেনহুয়ার নেতৃত্বে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলো মে মাসে রাশিয়ার দূরপ্রাচ্যের তেলের (ইএসপিও) দুই-তৃতীয়াংশ কিনতে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট এক ব্যবসায়ী রয়টার্সকে জানিয়েছেন। ইউক্রেন যুদ্ধের আগে এর পরিমাণ ছিল এক-তৃতীয়াংশ। মে মাসে এরই মধ্যে ২ কোটি ৪০ লাখ ব্যারেল তেল রপ্তানি করেছে রাশিয়া। গত এপ্রিলের চেয়েও যা ৬ শতাংশ বেশি।
তিন ব্যবসায়ী রয়টার্সকে বলেছেন, মে মাসে শুধু সিনোপেক ইএসপিও পাইপলাইন দিয়ে রাশিয়ার তেলের ১০টি চালান পাওয়ার কথা, যা ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর আগে ছিল ৫টি চালান। এর মধ্যে কিছু চালান আসবে দুবাই ক্রুড অয়েলের চেয়ে প্রতি ব্যারেলে রেকর্ড ২০ ডলার মূল্য ছাড়ে।
জাহাজের তথ্য ও ঘটনা সম্পর্কে অবহিত ব্যবসায়ীরা বলছেন, চীনের রাষ্ট্রমালিকানাধীন তেল কোম্পানি ঝেনহুয়া খুব বড় নয়। ফলে রাশিয়ার তেল আমদানির জন্য তারা জাহাজ ভাড়া করছে।
প্রতিরক্ষা খাতে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নরকিনো দুই দশকেরও আগে তেলের ব্যবসায় নাম লেখায়। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে তেল উৎপাদনের ছাড়পত্র পেয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। সম্প্রতি এর বাণিজ্যিক শাখা ঝেনহুয়া গ্যাস টার্মিনাল ও গ্যাসের ব্যবসায় বিনিয়োগ বাড়িয়েছে।
রাশিয়ার তেল এশিয়ায় আমদানির ক্ষেত্রে এত দিন লিভনার নাম তেমন একটা শোনা যেত না। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি গত এপ্রিলের শেষ দিক থেকে রাশিয়ার ৭০ লাখ ব্যারেল তেল চীনে সরবরাহ করেছে। ভরটেক্সা ও রেফিনিটিভের জাহাজ চলাচল নজরদারির তথ্য বিশ্লেষণ করে এ হিসাব পাওয়া যায়।