দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন জেলেনস্কি
দিনপঞ্জিকায় গত মাসের ২৪ তারিখে নড়েচড়ে বসেছিলেন বিশ্বনেতারা। সংবাদকর্মীদের ব্যস্ততা ছিল চরমে। পাঠক, দর্শক বারবার চোখ রাখছিলেন গণমাধ্যমগুলোতে। ঘটনা যে একেবারে হঠাৎ ঘটেছিল, তা নয়। বেশ কয়েক দিন ধরেই চলছিল বাদানুবাদ, চোখরাঙানি, হুমকি-ধমকি। যুদ্ধ হবে, না হবে না—এমন ভাবনার মধ্য দিয়ে শেষমেশ ঠিকই বেধে গেল যুদ্ধ।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের এক আঙুলের ইশারাই ছিল যথেষ্ট। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি পুতিনের ঘোষণা পেয়ে রুশ সেনারা স্থল, আকাশ ও সমুদ্রপথে সর্বাত্মক হামলা শুরু করেন। হামলার পরপরই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি মাতৃভূমি রক্ষায় অস্ত্র তুলে নিতে ইউক্রেনবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। সেদিনটা ছিল জেলেনস্কির আহ্বান জানানোর শুরু। এরপর থেকে একটি মাস একের পর এক ভিডিও বার্তায় কতই না আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছেন তিনি। সহযোগিতার জন্য কত দেশের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।
জেলেনস্কি ভেবেছিলেন, হামলার পর পাশে পাবেন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোভুক্ত পশ্চিমা দেশগুলোকে। তবে শুরুর দিকে তাদের কাছ থেকে তিনি আশ্বাস ছাড়া খুব বেশি কিছু পাননি। তাই ভিডিও বার্তায় এসে বলেছেন, ‘ক্ষমতাধরেরা কেবল দেখছে, আমরা একাই লড়ছি।’
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপ ও পশ্চিমা বিশ্ব অবশ্য রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিকসহ একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এ ছাড়া জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মতো দেশগুলোও রাশিয়ার বিরুদ্ধে নানান নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো ইউক্রেনে অস্ত্রসহায়তা দিয়েছে। তবে রাশিয়াকে দমানো যায়নি।
রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনে একের পর এক শহর বিধ্বস্ত হতে থাকে। রাজধানী কিয়েভ রক্ষায় নো–ফ্লাই জোনের জন্য পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর কাছে আহ্বান জানান জেলেনস্কি। তবে ন্যাটো সে আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। ন্যাটোর মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ বলেন, এ রকম পদক্ষেপ নিলে ইউরোপে পুরোদমে যুদ্ধ বেধে যেতে পারে। আর ন্যাটোর কাজ হলো যুদ্ধের বিস্তার ঠেকানো।
শুধু এ–ই নয়, ন্যাটোর দুয়ারে আরও একবার ধাক্কা খেয়েছেন জেলেনস্কি। ন্যাটোর সদস্যপদ পাওয়ার প্রত্যাশা পূরণ হয়নি ইউক্রেনের। ন্যাটো এ ব্যাপারে আগ্রহী নয় বুঝতে পেরে জেলেনস্কি এবিসি নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তাই বলেছেন, তিনি বুঝতে পেরেছেন, ন্যাটো ইউক্রেনকে সদস্য করতে প্রস্তুত নয়, তাই তিনি বিষয়টিতে জোর দিচ্ছেন না। ইউক্রেন হাঁটু গেড়ে কারও কাছে কিছু ভিক্ষা করবে না।
যদিও ইউক্রেনের ন্যাটোর সদস্যপদ হওয়া না–হওয়ার বিষয়টি বিরোধের অন্যতম কারণ ছিল। এদিকে রাশিয়ার অন্যতম শর্ত ছিল, ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হতে পারবে না। নিরাপত্তার খাতিরে এমন দাবি তুলেছিল বলে জানিয়েছে রুশ গণমাধ্যম। সে সময় অনড় থাকলেও পরে সে অবস্থান থেকে জেলেনস্কির সরে আসায় মনে হয়, তিনি রাশিয়াকে শান্ত করতে চান।
মারিউপোল, খেরসন, খারকিভ, কিয়েভের কাছে রুশ সেনাবাহিনীর হামলা তীব্র হয়েছে। চলছে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াইও। গতকালই কিয়েভের পূর্ব দিকে ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত রুশ বাহিনী পিছু হটেছে বলে দাবি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। ইউক্রেনে এখন পর্যন্ত রাশিয়ার ১৫ হাজার সেনা নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে ন্যাটো।
এ পর্যায়ে এসে জেলেনস্কি আলোচনার জন্য রাশিয়ার প্রতি জোরালো আহ্বান জানিয়েছেন। দেরি না করে মস্কোর সঙ্গে শান্তি ও নিরাপত্তা আলোচনা শুরুর আহ্বান জানিয়ে জেলেনস্কি বলেছেন, এখন সাক্ষাতের সময়, আলোচনার সময়। হামলা শুরুর পর রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতিনিধিরা কয়েক দফা বৈঠকে বসেছেন। তবে এখন পর্যন্ত দুই পক্ষ কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি। তাই পুতিনের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় বসতে বারবারই আহ্বান জানাচ্ছেন জেলেনস্কি। পুতিনের মন গলাতে সব বিষয়ে আলোচনায় রাজি বলেও জানিয়েছেন ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট। পুতিন রাজি হলে ক্রিমিয়া, দনবাসসহ ‘সব বিষয়ে’ আলোচনা হতে পারে, এমনটাও বলেছেন। এ নিয়ে বিতর্ক ও গণভোটেও রাজি জেলেনস্কি।
পুতিনের সঙ্গে বৈঠক নিয়ে সহযোগিতার জন্য যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আইনপ্রণেতাদের সঙ্গে আলোচনা করার পর জেলেনস্কি ইসরায়েলের সহযোগিতাও চেয়েছেন। রাশিয়া গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা চালানোর ১৫ দিন পর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করতে মস্কোয় যান ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট। প্রাণহানি কমাতে এবং এই সামরিক অভিযানের ইতি টানতে এ পদক্ষেপ নেন তিনি। সে সময় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর সঙ্গে একাধিকবার কথা বলেন তিনি। সে সময় বেনেট বলেছিলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা রাখা ইসরায়েলের নৈতিক দায়িত্ব। তবে এ ব্যাপারে পরে ইসরায়েলের অনাগ্রহ দেখা গেছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট মধ্যস্থতাকারীর কাজ থেকে বিরত থেকেছেন। ইউক্রেনের কাছে আয়রন ডোম ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বিক্রিতে ইসরায়েলের অনীহা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জেলেনস্কি।
রাশিয়ার পরবর্তী লক্ষ্য ন্যাটো হতে পারে—এমন হুঁশিয়ারিও দেন তিনি। তবে তাতেও খুব বেশি কাজ হয়নি। আপাতত অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম নিয়েই খুশি থাকতে হবে তাঁকে।
এক মাসের মাথায় এসে স্থানীয় সময় গতকাল বৃহস্পতিবার ন্যাটোর শীর্ষ সম্মেলন হয়েছে। ওই সম্মেলনে ভিডিও কলের মাধ্যমে যোগ দেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। ইউক্রেনে ন্যাটো জোটের শক্তির একাংশ প্রয়োজন বলে তিনি জানান। রাশিয়ার হামলা রুখতে সবাইকে সোচ্চার হতে দাবি জানান। সম্মেলনে ইউক্রেন সীমান্তে সামরিক শক্তি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ন্যাটো। ইউক্রেনকে আরও অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করতে একমত হয়েছে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো।
শুধু বিশ্বনেতারাই নন, সহযোগিতার জন্য বিশ্ববাসীর দুয়ারেও কড়া নেড়েছেন জেলেনস্কি। সম্মেলনের আগে রুশ হামলার এক মাস পূর্তি উপলক্ষে তিনি বিশ্বের সব জায়গা রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করার আহ্বান জানান।
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর পর থেকেই ন্যাটোর সহায়তা চেয়ে আসছেন জেলেনস্কি। তিনি নো-ফ্লাই জোন কার্যকরেরও দাবি জানিয়ে আসছেন। জবাবে এর মধ্যেই ন্যাটোর সদস্যভুক্ত বেশ কয়েকটি দেশ সামরিক সহায়তা পাঠিয়েছে। গতকাল সম্মেলনেও একই দাবি করেন জেলেনস্কি। রাশিয়ার পরবর্তী লক্ষ্য ন্যাটো হতে পারে—এমন হুঁশিয়ারিও দেন তিনি। তবে তাতেও খুব বেশি কাজ হয়নি। আপাতত অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম নিয়েই খুশি থাকতে হবে তাঁকে।
শুরুটা যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বকে দিয়ে। এরপর ন্যাটো, ইসরায়েল, পুতিনের দুয়ার ঘুরে এবার বিশ্ববাসীর দরজায়ও কড়া নাড়লেন জেলেনস্কি। দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত তাঁর ভাগ্যে শিকা ছিঁড়ে কি না।