তেল-গ্যাসের জন্য রাশিয়ার ওপর বিশ্ব কতটা নির্ভরশীল
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) চলতি বছরের শেষ নাগাদ রাশিয়ার তেল ক্রয় পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা করছে।
কিন্তু রাশিয়ার গ্যাস আমদানি বন্ধের বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যদের মধ্যে এখনো কোনো ঐকমত্য হয়নি।
তেল-গ্যাসের ওপর নিষেধাজ্ঞা
ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লিয়েন ঘোষণা দিয়েছেন, ইইউর সদস্যদেশগুলো যাতে ২০২২ সালের পর রাশিয়ার তেল না কেনে, সে জন্য নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
তবে ইইউ সদস্য হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়া ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল ক্রয় চালিয়ে যেতে সক্ষম হবে।
গত মার্চে ইইউ এক বছরের মধ্যে গ্যাস আমদানি দুই-তৃতীয়াংশ কমাতে অঙ্গীকার করে। আরও কী করা যায়, তা নিয়ে জোটের মধ্যে আলোচনা চলছে।
যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে রাশিয়ার তেল, গ্যাস ও কয়লা আমদানির ওপর পূর্ণ নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাজ্য ধীরে ধীরে চলতি বছরের শেষ নাগাদ রাশিয়া থেকে তেল আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করবে।
রাশিয়া সতর্ক করে বলেছে, তার তেল নিষিদ্ধ করলে তা বিশ্ববাজারের জন্য বিপর্যয়কর পরিণতি ডেকে আনবে।
নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইইউতে জীবাশ্ম জ্বালানি বিক্রি করে রাশিয়া তার মাসিক আয় প্রায় দ্বিগুণ করেছে। সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার এ তথ্য দিয়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর তেল ও গ্যাসের দাম বেড়ে যায়। এ যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়া থেকে প্রতি মাসে প্রায় ২২ বিলিয়ন ইউরোর জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানি করেছে ইইউ। অথচ ২০২১ সালে ইইউ রাশিয়া থেকে মাসে গড়ে ১২ বিলিয়ন ইউরোর জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানি করে।
রাশিয়া কত তেল রপ্তানি করে
তেল উৎপাদনে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের পরই রয়েছে রাশিয়া। অর্থাৎ, রাশিয়া বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশ।
নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার আগে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল রপ্তানির প্রায় অর্ধেক ইউরোপে যেত।
২০২০ সালে নেদারল্যান্ডস ও জার্মানি দৈনিক হিসাবে সবচেয়ে বেশি রাশিয়ার তেল আমদানি করেছে।
ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির (আইইএ) তথ্য অনুসারে, স্লোভাকিয়া গত বছর তাদের মোট তেল আমদানির ৯৬ শতাংশ করেছে রাশিয়া থেকে। হাঙ্গেরির ক্ষেত্রে এ হার ৫৮ শতাংশ। তেলের বিকল্প সরবরাহকারী খুঁজে পেতে এ দেশ দুটিকে অতিরিক্ত এক বছর সময় দেওয়া হবে।
গত বছর যুক্তরাজ্যের মোট তেল আমদানির ৮ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে। আর যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এ হার ছিল ৩ শতাংশ।
রাশিয়ার তেলের বিকল্প কী
বিশ্লেষক বেন ম্যাকউইলিয়ামস বলেন, গ্যাসের চেয়ে তেলের বিকল্প সরবরাহকারী খুঁজে পাওয়া সহজ হওয়া উচিত। কারণ, কিছু তেল রাশিয়া থেকে আসে। এ ছাড়া অন্যত্র থেকেও তেলের প্রচুর চালান আসে।
কিছু দেশ, যারা আইইএর সদস্য, তারা তাদের মজুত থেকে ১২০ মিলিয়ন ব্যারেল সমতুল্য তেল ছাড় করেছে। এটি এ দেশগুলোর ইতিহাসে তেলের রিজার্ভ থেকে সবচেয়ে বড় ছাড়।
মার্চের শেষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন জ্বালানির উচ্চমূল্য কমানোর প্রয়াসে আমেরিকার মজুত থেকে বড় ধরনের তেল ছাড়ের নির্দেশ দেন।
পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র চায়, সৌদি আরব তার তেল উৎপাদন বাড়াক। এ ছাড়া ভেনেজুয়েলার তেল সম্পদের ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার কথা ভাবছে যুক্তরাষ্ট্র।
রাশিয়া কীভাবে গ্যাসপ্রবাহ বন্ধ করেছে
ইউক্রেনে হামলার পরও রাশিয়া ইউরোপের অনেক দেশে বিপুল পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে।
ইউক্রেনে আগ্রাসনের জেরে পশ্চিমা শক্তিগুলো রাশিয়ার ওপর আর্থিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। জবাবে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন ঘোষণা দেন, অবন্ধুসুলভ দেশগুলোকে গ্যাসের জন্য রাশিয়ার মুদ্রায় অর্থ পরিশোধ করতে হবে।
একপর্যায়ে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জ্বালানি সংস্থা গাজপ্রম পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়ায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। একই সঙ্গে তারা ঘোষণা দিয়েছে, রাশিয়ার মুদ্রা রুবলে অর্থ প্রদান না করলে এই সরবরাহ পুনরায় চালু করা হবে না।
ইইউ বলেছে, তারা রাশিয়ার এ পদক্ষেপকে একধরনের ‘ব্ল্যাকমেল’ বলে মনে করছে।
ইইউ অন্য অনেক দেশ চলতি মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে একই সমস্যার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে।
রুবলে অর্থ প্রদান করা হলে রাশিয়ার মুদ্রার পতন থামবে। দাম চাঙা হবে। সার্বিকভাবে রুশ অর্থনীতি উপকৃত হবে।
কারা রুবলে অর্থ প্রদান করছে
ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লিয়েন সতর্ক করে বলেছেন, রাশিয়ার দাবি মানার অর্থ ইইউর নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন। ইইউভুক্ত দেশগুলোর যেসব কোম্পানি এ কাজ করে চলছে, তাদের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি রয়েছে।
রাশিয়ার জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কত তাড়াতাড়ি কমিয়ে দেওয়া যায়, তা নিয়ে ইইউভুক্ত দেশগুলো বিভক্ত।
জার্মানি, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়াসহ ইইউভুক্ত কিছু দেশের কোম্পানি গ্যাসের জন্য গাজপ্রম ব্যাংকের মাধ্যমে ইউরোতে অর্থ প্রদান করতে সম্মত হয়েছে। রাশিয়ার এই ব্যাংক গ্যাস বাবদ পেমেন্টকে রুবলে রূপান্তর করবে।
ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস জানিয়েছে, অস্ট্রিয়া ও ইতালির গ্যাস কোম্পানিগুলোও গাজপ্রম ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলার পরিকল্পনা করছে।
রাশিয়ার গ্যাসের ক্রেতারা কীভাবে নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন এড়াতে পারে, সে বিষয়ে ইইউ গত সপ্তাহে একটি নির্দেশিকা দেয়।
কিন্তু ইইউর এই প্রাথমিক নির্দেশিকার ব্যাখ্যা নিয়ে জোটভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভিন্ন মত রয়েছে। ইইউর কূটনীতিকেরা বলেছেন, তাঁরা এ বিষয়ে আরও স্পষ্টতা চান।
ইউরোপে কত গ্যাস সরবরাহ করে রাশিয়া
২০১৯ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করে, তার ৪১ শতাংশ রাশিয়া থেকে আসে।
যদি ইউরোপে রাশিয়ার গ্যাসের সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে বিশেষ করে ইতালি ও জার্মানি বড় ধরনের বিপদে পড়বে। কারণ, তারা সবচেয়ে বেশি গ্যাস আমদানি করে।
যুক্তরাজ্যকে প্রায় ৫ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ করে রাশিয়া। আর রাশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র কোনো গ্যাস আমদানি করে না।
রাশিয়া বেশ কয়েকটি প্রধান পাইপলাইনের মাধ্যমে ইউরোপে গ্যাস পাঠায়। এ গ্যাস প্রথমে আঞ্চলিক সংরক্ষণাগারগুলোতে যায়। তারপর তা মহাদেশজুড়ে বিতরণ করা হয়।
রাশিয়ার গ্যাসের বিকল্প কী
গ্যাসের জন্য ইউরোপ অন্য রপ্তানিকারকদের দিকে যেতে পারে। এই দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে কাতার, আলজেরিয়া বা নাইজেরিয়া। কিন্তু ইউরোপের চাহিদা অনুযায়ী দ্রুত গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে এই রপ্তানিকারকদের বাস্তবিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র চলতি বছরের শেষ নাগাদ ইউরোপে অতিরিক্ত ১৫ বিলিয়ন ঘনমিটার তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) পাঠাতে সম্মত হয়েছে।
এ ছাড়া ইউরোপ জ্বালানিশক্তির অন্যান্য উৎস, যেমন বায়ুশক্তির ব্যবহার বাড়াতে পারে। কিন্তু তা যেমন দ্রুত সময়ের মধ্যে করা সম্ভব নয়, তেমনি তা করা সহজও নয়।
বিবিসি অবলম্বনে