ইউক্রেনে নানা হিসাব-নিকাশ করেই সামরিক অভিযান শুরু করেছে রাশিয়া। এটা দুই দেশ ও বিশ্বের অন্য দেশগুলোর ওপর কী প্রভাব ফেলবে, এমন অনেক হিসাব মাথায় রেখে জেতার লক্ষ্য নিয়েই রাশিয়া এ হামলা চালিয়েছে। রাশিয়া প্রতিবেশী দেশে হামলা চালাচ্ছে—রুশ অভিযানে আক্ষরিক অর্থে এটা বোঝালেও মূলত দীর্ঘদিনের শত্রু যুক্তরাষ্ট্রকে লক্ষ্য করে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরি, ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়া ও ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে হামলা চালিয়েছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। সেই স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন যে হুমকি হয়ে উঠেছিল, তার সঙ্গে ইউক্রেনে হামলার ধরনের বেশ মিল পাওয়া যাচ্ছে।
বিগত দুই দশকের মধ্যে এটাই রাশিয়ার সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী সামরিক অভিযান। বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্র যেসব সামরিক অভিযান চালাচ্ছে, তার সঙ্গে রাশিয়ার এই অভিযানের মিল নেই।
১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরি, ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়া ও ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে হামলা চালিয়েছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। সেই স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন যে হুমকি হয়ে উঠেছিল, তার সঙ্গে ইউক্রেনে হামলার ধরনের বেশ মিল পাওয়া যাচ্ছে।
প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বাগাড়ম্বরপূর্ণ বক্তব্য অনুযায়ী, রাশিয়া সবে এ যাত্রা শুরু করেছে। সম্প্রতি পুতিন তাঁর বক্তব্যে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এ ছাড়া গত সোমবার পূর্ব ইউক্রেনের রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ন্ত্রিত দুটি এলাকা দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন পুতিন। তখনই ‘শান্তিরক্ষী হিসেবে’ ইউক্রেনের ওই সব অঞ্চলে সেনা মোতায়েনের নির্দেশ দেন তিনি। এরপর সেখানে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ চালানোর ঘোষণা দিলেন। বাস্তবে রাজধানী কিয়েভসহ পুরো ইউক্রেনে হামলা চালানো হয়েছে।
কিউবা বিপ্লবের পর ফিদেল কাস্ত্রোর সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। নিজের সুবিধার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এই পথে হেঁটেছিল। একই ঘটনা ঘটেছে স্লোভেনিয়া, মেসিডোনিয়া ও বসনিয়ার ক্ষেত্রেও। পূর্ব ইউক্রেনের ওই দুই অঞ্চলকে দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে রাশিয়া। অর্থাৎ ইউক্রেনবাসীর সার্বভৌমত্বের অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার বৈধতা দেওয়ার ক্ষেত্রে পুতিন ওয়াশিংটনের মতোই পথ বেছে নিতে পারেন।
আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে রাশিয়ার অভিযানের নিন্দা জানিয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো। এ ছাড়া রাশিয়ার বিরুদ্ধে দ্রুত বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা আরোপের সূচনা হয়েছে মাত্র। তারা রাশিয়াকে একঘরে করার পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে।
কিন্তু পশ্চিমাদের এই পদক্ষেপে অপ্রস্তুত নয় রাশিয়া; বরং উল্টো প্রস্তুতই মনে হচ্ছে পুতিনকে। ইতিহাসে চোখ ফেরালে দেখা যাবে, রাশিয়ার মতো দেশগুলোর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তাদের থামানো যায় না। সেটা যত বড় নিষেধাজ্ঞাই হোক। যখন জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে আসে, তখন নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি আমলে নেয় না শক্তিধর দেশগুলো।
যদি ইরানের সঙ্গে তুলনা করা যায়, তবে রাশিয়া অনেক শক্তিশালী দেশ। এই ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো। এরপরও ইরানকে তার অবস্থান থেকে খুব বেশি সরানো যায়নি।
রাশিয়ার ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটতে পারে। যখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে ও দেশটি এ জন্য ভুগতে শুরু করবে, তখন মস্কোও কঠোর অবস্থানে যাবে। চীনের দিকে ঝুঁকে পড়বে রাশিয়া। চীন এ বিষয়ে সাহায্য করতে প্রস্তুত থাকবে বলে মনে হচ্ছে। কারণ, এর আগে ইরানকে এভাবে সাহায্য করেছে চীন। অর্থনৈতিকভাবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা চীন যে রাশিয়াকে সাহায্য করবে, তা ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে। কারণ, চলতি মাসের শুরুতে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও পুতিন বৈঠক করে যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন। তাঁরা পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোর সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে বার্তা দিয়েছেন।
কিউবা বিপ্লবের পর ফিদেল কাস্ত্রোর সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। নিজের সুবিধার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এই পথে হেঁটেছিল। একই ঘটনা ঘটেছে স্লোভেনিয়া, মেসিডোনিয়া ও বসনিয়ার ক্ষেত্রেও। পূর্ব ইউক্রেনের ওই দুই অঞ্চলকে দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে রাশিয়া। অর্থাৎ ইউক্রেনবাসীর সার্বভৌমত্বের অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার বৈধতা দেওয়ার ক্ষেত্রে পুতিন ওয়াশিংটনের মতোই পথ বেছে নিতে পারেন।
যুক্তরাষ্ট্র ও এর ইউরোপীয় মিত্ররা জাতিসংঘের ম্যানডেট ‘রেসপনসিবিলিটি টু প্রটেক্ট’ (আরটুপি) নীতি ব্যবহার করে লিবিয়ার মতো রাষ্ট্রে হামলা চালিয়েছে। রাশিয়া একই পথ বেছে নিয়েছে ইউক্রেনের ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রে ক্রেমলিন বলছে, তারা সেখানে ‘গণহত্যা’ থামাতে চায়।
রুশপন্থীরা বলে থাকেন, আরটুপি নীতি আবিষ্কার যুক্তরাষ্ট্রের। কোনো যুদ্ধ শুরুর জন্য মার্কিন সরকার এই নীতি ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু রাশিয়া এই নীতি ব্যবহার করে থাকে যুদ্ধ থামাতে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে রাশিয়ার পদক্ষেপের মিল রয়েছে। সিরিয়ার কাছ থেকে গোলান মালভূমি ও ফিলিস্তিনের কাছ থেকে পূর্ব জেরুজালেম দখল করার পর তা ইসরায়েলের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর এ স্বীকৃতি অবৈধ। ঠিক একই পথে হাঁটল রাশিয়া। ইউক্রেনের দুটি অঞ্চলকে স্বীকৃতি দিলেন পুতিন।
বিভিন্ন দেশে সরকার পরিবর্তনে পদক্ষেপ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সর্বশেষ ভেনেজুয়েলায় এই চেষ্টা চালিয়েছে দেশটি। রাশিয়াও হয়তো ইউক্রেনে এমন পদক্ষেপ নিতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের মতো একই ধরনের কৌশল বেছে নিয়েছে রাশিয়া। কিন্তু দেশটির ব্যর্থতা থেকে রুশ সরকার কোনো শিক্ষা নেয়নি। এমনকি কোনো দেশই আফগানিস্তান, সিরিয়া ও ইরাকের ভুল থেকে শিক্ষা নেয়নি।
হতাশার বিষয় হলো, স্নায়ুযুদ্ধ শেষে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তাকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজেদের শক্তিমত্তা প্রদর্শন করে এসেছে। রাশিয়ার এ হামলার মধ্য দিয়ে সেই প্রতিযোগিতারই প্রতিফলন ঘটল। এটা নতুন আরেকটি স্নায়ুযুদ্ধের দিকেই বিশ্বকে ঠেলে দিচ্ছে। আর সেটা যদি হয় তবে ইউরোপ তথা বিশ্বের জন্য এটি হবে একটি অন্ধকার যুগের সূচনা।