রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ
আলোচনার মধ্যেও থামেনি হামলা
অস্ত্রবিরতি ও ইউক্রেন ছাড়ার সুযোগ দিতে মানবিক করিডর বাস্তবায়নের ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি ছাড়াই শেষ হলো প্রথম দিনের আলোচনা।
ইউক্রেনে রুশ হামলা চলছেই। কোনো কোনো শহরে দুই পক্ষের মধ্যে লড়াইয়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে। দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে বহু মানুষ। আটকে পড়া মানুষের সংখ্যাও অনেক।
এমন পরিস্থিতিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান তৃতীয় সপ্তাহে গড়িয়েছে গতকাল বৃহস্পতিবার। এদিন তুরস্কের আন্তালিয়া শহরে শান্তি আলোচনায় বসেছিলেন দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। তবে যুদ্ধ বন্ধের কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। অস্ত্রবিরতি ও বেসামরিক মানুষকে ইউক্রেন ছাড়ার সুযোগ দেওয়ার বিষয়েও কোনো অগ্রগতি নেই। ফলাফল ছাড়াই শেষ হয়েছে প্রথম দিনের আলোচনা। অবশ্য আলোচনা চালিয়ে যেতে সম্মত হয়েছে দুই পক্ষই।
গতকাল অল্প সময়ের এই আলোচনা শেষে সংবাদ সম্মেলনে ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রি কুলেবা বলেন, মানবিক সংকটের সুরাহার ব্যাপারে কাজ করতে তাঁরা সম্মত হয়েছেন। তিনি বলেন, মানবিক ইস্যুতে ২৪ ঘণ্টার অস্ত্রবিরতির বিষয়টি তোলা হয়েছিল। তবে এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হয়নি। দিমিত্রি বলেন, ‘আমি আবারও বলতে চাই যে ইউক্রেন আত্মসমর্পণ করেনি, আত্মসমর্পণ করছে না এবং আত্মসমর্পণ করবে না।’
রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ কোনো ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব দেননি এবং ইউক্রেনের নিরস্ত্রীকরণসহ নিরপেক্ষ অবস্থানের দাবি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। একই সঙ্গে তিনি অভিযোগ করেন, ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ করে আগুনে ঘি ঢালছে পশ্চিমারা। যদিও তিনি ইউক্রেন সংকট সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চান বলে জানান। লাভরভ এ–ও জানান, পরিকল্পনা অনুযায়ী ইউক্রেনে তাদের সামরিক অভিযান চলছে।
তুরস্কের মধ্যস্থতায় শুরু হওয়া এ শান্তি আলোচনা নিয়ে আশাবাদী ছিলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। আশার কথা শুনিয়েছিল ইসরায়েলও। গতকাল আলোচনার পর তুরস্ক ও ইসরায়েলের পক্ষ থেকে কিছু বলা হয়নি। এর আগেও রাশিয়া ও ইউক্রেন আলোচনায় বসেছিল। বেলারুশ সীমান্তে হওয়া কয়েক দফা ওই আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি।
ইউক্রেনে ‘অতিসত্বর অস্ত্রবিরতি কার্যকর’ করার দাবি জানিয়েছে জার্মানি ও ফ্রান্স। গতকাল রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে একযোগে টেলিফোনে কথা বলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ ও জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ। তিন নেতাই আগামী কয়েক দিন নিজেদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখার ব্যাপারে একমত হয়েছেন।
হামলা থামেনি
আলোচনার মধ্যেও গতকাল ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর হামলা অব্যাহত ছিল। আগের দিন বুধবার রাতভর সুমি এলাকায় বিমান হামলা চালায় রাশিয়া। রুশ
হামলায় দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলীয় মারিউপল শহরে একটি মা ও শিশু হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শহর কর্তৃপক্ষ জানায়, হামলায় এক শিশুসহ তিনজন নিহত হয়েছে। এ হামলাকে ‘যুদ্ধাপরাধ’ হিসেবে অভিহিত করছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) গতকাল জানায়, ২৪ ফ্রেব্রুয়ারি থেকে ৮ মার্চ পর্যন্ত ইউক্রেনের বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রুশ বাহিনীর ২৪টি হামলার ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। এসব হামলায় অন্তত ১২ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১৭ জন। এর মধ্যে নিহত দুজন স্বাস্থ্যকর্মী বলে তারা নিশ্চিত হয়েছে।
কিয়েভ ঘিরে লড়াই
কিয়েভের আঞ্চলিক প্রশাসন জানায়, রাজধানী ঘিরে আসা-যাওয়ার বিভিন্ন পথে রুশ বাহিনীর সঙ্গে ইউক্রেনের সেনাদের ব্যাপক লড়াই হচ্ছে। এর মধ্যে পশ্চিমের ঝিতোমির ও মাকারিভ শহরমুখী মহাসড়কে ব্যাপক সংঘাতে জড়িয়েছে দুই পক্ষ।
এ ছাড়া সংঘাতের কারণে কিয়েভের উপকণ্ঠের বুচা, ইরপিন ও হোস্তোমেলসহ রাজধানীর উত্তরের ভিশোরোদ বেসামরিক লোকজনের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। আঞ্চলিক প্রশাসন জানায়, মানবিক করিডরের মাধ্যমে আজ (বৃহস্পতিবার) বুচা, ইরপিন, হোস্তোমেল ও বোরোদিয়ানকা থেকে বেসামরিক লোকজন সরিয়ে আনার পরিকল্পনা আছে। আগের দিন বুধবার ওই সব এলাকা থেকে কিছুসংখ্যক বেসামরিক লোকজনকে সরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
কিয়েভের মেয়র ভিতালি ক্লিসৎশকো একটি টেলিভশন চ্যালেনকে বলেন, রুশদের প্রধান লক্ষ্য কিয়েভের দখল। তারা রাজধানী ঘিরে ফেলে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের পরিকল্পনা বাস্তবে ফলছে না। তিনি বলেন, ‘আমাদের লোকেরা বুচা, ভোরজেল, ইরপিন, হোস্তোমেলে কঠিন লড়াই করছেন। তাঁদের ধন্যবাদ। তাঁদের কারণে রাজধানীকে ঘিরে সব পরিকল্পনা ব্যর্থ হচ্ছে।’
মেয়র ক্লিসৎশকো বলেন, কিয়েভের প্রতি দুজনের একজন শহর ছেড়ে গেছে। এখন ২০ লাখের কিছু কম মানুষ শহরে রয়েছে এবং শহরটি দুর্গে পরিণত হয়েছে—প্রতিটি সড়ক, প্রতিটি ভবন এখন দুর্গ।
রাশিয়ার চলমান সামরিক অভিযানে এ পর্যন্ত ইউক্রেনের ২৩ লাখের বেশি মানুষ আশপাশের দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন। প্রতিদিনই নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দেশ ছাড়ছেন হাজার হাজার মানুষ।
ইউক্রেন বলছে, রাশিয়ার অব্যাহত হামলার কারণে বিভিন্ন শহরে আটকে পড়া বেসামরিক নাগরিক চরম মানবিক সংকটে পড়েছেন। এর মধ্যে মারিউপলে শহরের বাসিন্দাদের অবস্থা খুবই খারাপ। ঠান্ডায় তাদের দিন কাটছে বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায়। নেই পানির সরবরাহ।
‘রুশ কমান্ডার নিহত’
ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় গতকাল কিয়েভের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে রাশিয়ার একটি সেনাদলকে (রেজিমেন্ট) পরাস্ত করার দাবি করেছে। একই সঙ্গে তাদের দাবি, ওই রেজিমেন্টের কমান্ডার কর্নেল এ. জাখারভ নিহত হয়েছেন। এক টুইটে এ-সংক্রান্ত একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়েছে। সিএনএন ভিডিওটির সত্যতা নিশ্চিত করেছে। তবে এ ব্যাপারে তাৎক্ষণিকভাবে রাশিয়ার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এ ছাড়া ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, এখন পর্যন্ত ১২ হাজার রুশ সেনার মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া রাশিয়ার উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ট্যাংক ও কামান ধ্বংস, যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়েছে। অন্যদিকে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম দুই সপ্তাহে রাশিয়ার পাঁচ থেকে ছয় হাজার সেনা নিহত হয়েছেন বলে ধারণা যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের।
‘অর্থনৈতিক যুদ্ধ’
রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লাভরভ গতকাল বলেন, পশ্চিমাদের আরোপ করা অবরোধ রাশিয়া সামাল দেবে এবং এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসবে। তাঁর ভাষায়, ‘আমি আপনাদের নিশ্চিত করে বলতে পারি, আমরা পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠব এবং পশ্চিমের ওপর নির্ভর না করে আমাদের জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রের জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করব।’
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ গতকাল স্বীকার করেন, ‘নজিরবিহীন’ অবস্থায় পড়েছে রাশিয়ার অর্থনীতি। রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমারা ‘অর্থনৈতিক যুদ্ধ’ শুরু করেছেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে রাশিয়া এবং দেশটির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে চলেছে পশ্চিমা দেশগুলো ও তাদের মিত্ররা। এর ধারাবাহিকতায় গতকাল ফুটবল ক্লাব চেলসির মালিক রোমান আব্রামোভিচের সব সম্পদ জব্দ করার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাজ্য। রুশ এই ধনকুবের পুতিনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।