যুক্তরাষ্ট্র-চীন সংঘাত অসহনীয় বিপর্যয় ডেকে আনবে
চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সংঘাত হলে তা ‘অসহনীয় বিপর্যয়’ ডেকে আনবে। তাই চীন সংঘাতের পরিবর্তে আলোচনায় আগ্রহী। সিঙ্গাপুরে ‘সাংগ্রি-লা ডায়ালগ’ শীর্ষক এশিয়ার দেশগুলোর শীর্ষ প্রতিরক্ষা সম্মেলনের শেষদিন আজ রোববার চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লি সাংফু এমন মন্তব্য করেন।
চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার একটি প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার একদিন পরই এ কথা বললেন।
গত মার্চ মাসে চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব নেন লি। সিঙ্গাপুরের এ সম্মেলন তাঁর প্রথম কোনো গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক উপস্থিতি। সম্মেলনে সাংফু বলেন, ‘চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। তবে তাই বলে অভিন্ন স্বার্থে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার ও সহযোগিতা গভীর করতে করার চেষ্টা করা থেকে বিরত থাকা উচিত হবে না। এটা অনস্বীকার্য যে, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি গুরুতর সংঘাত বা কোনো সংঘর্ষ বিশ্বের জন্য এক অসহনীয় বিপর্যয় ডেকে আনবে।’
আন্তর্জাতিক ও দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে সম্পর্ক খুবই খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছে। এর মধ্যে রয়েছে তাইওয়ান, দক্ষিণ চীন সাগরে আঞ্চলিক বিরোধ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের ‘সেমিকন্ডাক্টর চিপ’ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞার মতো নানা বিষয়।
সিঙ্গাপুরে যখন চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের কূটনীতিকেরা সংঘাতের ঝুঁকি ও ভুল–বোঝাবুঝি নিয়ে বিতর্ক করছেন, তখন চীনের একটি যুদ্ধজাহাজ তাইওয়ান প্রণালিতে বিপজ্জনকভাবে মার্কিন যুদ্ধজাহাজের কাছ ঘেঁষে অতিক্রম করে।
মার্কিন নৌবাহিনীর অভিযোগ, চীনের যুদ্ধজাহাজের এই ধরনের তৎরপতা বিপজ্জনক এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
তবে চীনের সেনাবাহিনীর অভিযোগ, স্পর্শকাতর এলাকায় যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার যুদ্ধজাহাজ চলাচল ইচ্ছাকৃতভাবে ঝুঁকি উসকে দিচ্ছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় কমান্ড বলেছে, দুই দেশের যুদ্ধজাহাজ নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সমুদ্রে স্বাধীনভাবে যাতায়াত করছে।
প্রতিরক্ষা সম্মেলনে কানাডার প্রতিরক্ষামন্ত্রী অনিতা আনন্দ বলেন, আন্তর্জাতিক আইন যেখানে প্রযোজ্য, সেখানে তাঁদের যুদ্ধজাহাজ অবাধে চলবে। এর মধ্যে তাইওয়ান প্রণালিও রয়েছে।
লি সাংফু তাঁর বক্তব্যে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের নৌ-চলাচলের স্বাধীনতার অজুহাতে নৌপথে আধিপত্য দেখানোর সুযোগ নিতে দেবে না চীন। তবে লির বক্তব্যের পরে আঞ্চলিক বিশেষজ্ঞরা লিকে বিতর্কিত দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের ব্যাপক তৎপরতা ঘিরে প্রশ্ন তোলেন। তিনি সরাসরি এর জবাব না দিয়ে বলেন, এ অঞ্চলের বাইরের দেশের তৎপরতা উত্তেজনা বাড়াচ্ছে।
শনিবার মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন প্রতিরক্ষা ইস্যুতে আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের জন্য চীনের সমালোচনা করেন। তাঁর অভিযোগ, চীনের অনিচ্ছার কারণে পরাশক্তি দেশগুলোর মধ্যে আলোচনা বন্ধ হয়ে আছে। তিনি বলেন, ‘আলোচনা কোনো পুরস্কার নয়, এটা প্রয়োজন।’
লি তাঁর বক্তব্যে যথেষ্ট সংযত ছিলেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘কিছু দেশ অস্ত্র প্রতিযোগিতা বাড়িয়েছে এবং ইচ্ছাকৃতভাবে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। শীতল যুদ্ধের মানসিকতা এখন তৈরি হচ্ছে, যা নিরাপত্তা ঝুঁকিকে ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে। নিপীড়ন ও আধিপত্য দেখানোর মানসিকতা ছেড়ে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।’
লির বক্তব্যের পর অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ চীনা কূটনীতিক কুই তিয়ানকাই বিশ্বস্ততার নিদর্শন হিসেবে চীনের কাছাকাছি অঞ্চলে মোতায়েন করা যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজ সরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানান। দুই পরাশক্তির মধ্যে প্রতিরক্ষা আলোচনা চালু রাখতে এ পদক্ষেপ নিতে বলেন কুই তিয়ানকাই।
সিঙ্গাপুরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী চোং জা ইয়ান বলেন, গতবারের সম্মেলনে চীনের অবস্থানের চেয়ে এবার লির সুর ও পন্থা বেশ ভদ্র ছিল। তবে তাঁদের বক্তব্য ছিল একই রকম। এতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে দূরত্বের প্রতিফলন স্পষ্ট হয়েছে। এ থেকে বর্তমান সমস্যার কোনো সমাধানের আশা করা ঠিক হবে না। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রতিযোগিতা চলবে।
গোয়েন্দাদের গোপন বৈঠক
বিশ্বের ২০টির বেশি দেশের গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সিঙ্গাপুরে এ সম্মেলনে একটি গোপন বৈঠক করেছেন। প্রতিরক্ষা সম্মেলনের পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এই বৈঠকটি হয়। এই বৈঠকের আয়োজক সিঙ্গাপুর সরকার।
গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের এমন বৈঠকের কথা আগে জানানো হয়নি। বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করেন দেশটির জাতীয় গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক এভ্রিল হেইনস। বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের চীনের প্রতিনিধিও ছিলেন। এ ছাড়া ভারতের বিদেশ বিষয়ক গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের (র) প্রধান সামন্ত গোয়েল বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বলে জানায় ভারতীয় একটি সূত্র।
বৈঠকের আলোচনা সম্পর্কে অবগত এক ব্যক্তি বলেছেন, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুর প্রেক্ষাপটে বৈঠকটি গুরুত্বপূর্ণ। আনুষ্ঠানিক ও খোলামেলা কূটনীতি যখন কঠিন হয়ে পড়ে, তখন বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা পরস্পরের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। বিশেষ করে উত্তেজনার সময় এই ধরনের বৈঠক খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থার বড় ধরনের বৈঠক বিরল। আর এ ধরনের কোনো বৈঠক হলেও তার খবর প্রায়ই প্রচার করা হয় না। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বৈঠকে রাশিয়ার কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না।