করোনাভাইরাসের উৎস কি কখনো জানা যাবে
করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার ও স্বাস্থ্য সংস্থা গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছে। আর তা হচ্ছে—এ ভাইরাসের উৎস কি কোনো প্রাণী, নাকি চীনের কোনো গবেষণাগার?
মার্কিন জ্বালানি বিভাগ সবকিছু মূল্যায়ন করে একটি সিদ্ধান্তে এসেছে। এ নিয়ে তারা একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে, যা এখনো প্রকাশ করা হয়নি। প্রতিবেদন তৈরির সঙ্গে জড়িত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, গবেষণাগার থেকে এ ভাইরাসের উৎপত্তি। তবে তাদের যুক্তি ‘খুব জোরালো’ নয়।
আবার জ্বালানি বিভাগের এ প্রতিবেদনের সঙ্গে একমত নয় মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগ। মার্কিন জ্বালানি বিভাগ যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের জ্বালানিনীতি দেখাশোনা করে এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎ ও পারমাণবিক অস্ত্রের গবেষণা ও উন্নয়নকাজের তদারক করে থাকে।
সার্সের মতো ভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর ব্যাপক উদ্বেগের সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় উহান ইনস্টিটিউট কয়েক বছর ধরে করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণা করছিল। তখনই ধারণা করা হচ্ছিল, করোনাভাইরাস হতে পারে পরবর্তী মহামারির উৎস।
মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র জন কিরবি গত সোমবার বলেন, শুধু যে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি, তা নয়; আসলে করোনাভাইরাস কীভাবে শুরু হয়েছিল, সে সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র সরকারও এখনো কোনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি।
জ্বালানি বিভাগের এ প্রতিবেদন চলতি সপ্তাহে প্রথম প্রকাশিত হয় ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে। এতে উল্লেখ করা হয়, নতুন গোয়েন্দা তথ্য এবং ২০২১ সালের নথিপত্রের ভিত্তিতে এ গোপন প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
হোয়াইট হাউস অবশ্য এ প্রতিবেদনের মূল্যায়ন সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। ২০২১ সালে প্রকাশিত মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনের মূল বিষয়বস্তুতে বলা হয়েছিল, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার একটি কমিটি মনে করে, ভাইরাসটি প্রথমে একটি প্রাণী থেকে মানবদেহে প্রবেশ করানো হয়। তবে তাদের এ দাবি খুব জোরালো নয়। আরেকটি কমিটি মনে করে, প্রথম মানবসংক্রমণ একটি গবেষণাগার থেকে হয়েছে। তাদের এ মূল্যায়নের ভিত আগের কমিটির চেয়ে বেশ জোরালো।
বিজ্ঞানীদের একটি অংশ গবেষণাগার থেকে করোনার উৎপত্তি—এমন তত্ত্বে বিশ্বাস করে। আবার আরেকাংশ মনে করে, এ ভাইরাস এসেছে প্রাণী থেকে। নীরবে প্রাণিদেহ থেকে মানবদেহে সংক্রমিত হয়েছে। অতীতেও ভাইরাসের ক্ষেত্রে এমনটা দেখা গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের সত্যিকারের উৎস হয়তো আরও অনেক বছর জানা যাবে না। এমনও হতে পারে, কখনোই জানা যাবে না।
সর্বশেষ এই প্রতিবেদন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আরও তদন্তের চাপ তৈরি করবেঅ্যালিনা চান, আণবিক জীববিজ্ঞানী, বোর্ড ইনস্টিটিউট অব এমআইটি অ্যান্ড হার্ভার্ড
আরও তদন্তের আহ্বান
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালকের কার্যালয় থেকে এ প্রতিবেদন নিয়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার ১৮টি ইউনিটের জ্বালানি বিভাগের প্রতিবেদনে ব্যবহৃত তথ্য যাচাই-বাছাই করার সুযোগ ছিল।
বোর্ড ইনস্টিটিউট অব এমআইটি অ্যান্ড হার্ভার্ডের আণবিক জীববিজ্ঞানী অ্যালিনা চান বলেন, নতুন গোয়েন্দা তথ্যে কী ছিল, সে সম্পর্কে তিনি খুব বেশি কিছু জানেন না। তবে যুক্তিসংগত কথা হচ্ছে, চীনের উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজির কর্মকাণ্ড করোনার এ উৎসের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পারে।
২০১৮ সালে উহানের ওই গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ও যুক্তরাষ্ট্রের একদল বিজ্ঞানী একটি গবেষণা প্রস্তাব করেছিলেন, যাতে কোভিডের মতো ভাইরাস নিয়ে কাজ করার কথা বলা হয়েছিল। ওই দলে সহলেখক হিসেবে অ্যালিনাও ছিলেন।
ওই গবেষণা প্রস্তাব করার দুই বছরেরও কম সময় পর উহান নগরে এমন একটি ভাইরাস মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। সার্সের মতো ভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর ব্যাপক উদ্বেগের সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় উহান ইনস্টিটিউট কয়েক বছর ধরে করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণা করছিল। তখনই ধারণা করা হচ্ছিল, করোনাভাইরাস হতে পারে পরবর্তী মহামারির উৎস।
কোনো গোয়েন্দা সংস্থাই বলেনি, করোনাভাইরাস ইচ্ছাকৃতভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনের সারবস্তুই বলে দিচ্ছে, এ ভাইরাসকে গবেষকেরা জীবাণু অস্ত্র বলে মনে করেননি।
করোনাভাইরাসের উৎস নিয়ে লেখা বইয়ের সহলেখক অ্যালিনা চান বলেন, গবেষণাগারে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ গবেষণাগারের দুর্ঘটনা সম্পর্কে জানে না। কারণ, এসব নিয়ে প্রকাশ্যে কথাবার্তা হয় না। এ ধরনের দুর্ঘটনা ভয়াবহ রোগজীবাণু নিয়ে যেকোনো কাজকে আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করার গুরুত্বকে তুলে ধরছে।
গত বছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) গবেষণাগারের দুর্ঘটনা নিয়ে আরও গভীর তদন্তের সুপারিশ করেছে। অ্যালিনা বলেন, তিনি আশা করছেন, সর্বশেষ এ প্রতিবেদন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আরও তদন্তের চাপ তৈরি করবে।
চীন শুরু থেকে বলে আসছে, চীনের গবেষণাগার থেকে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি হয়েছে—এমন অভিযোগ ‘ভিত্তিহীন’।
প্রাণিতত্ত্বের প্রতি সমর্থন
অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, প্রাণী থেকে মানবদেহে করোনাভাইরাস সংক্রমণের তত্ত্ব অনেক বেশি যুক্তিগ্রাহ্য। তাঁরা তত্ত্ব দিয়ে বলছেন, করোনাভাইরাস প্রথমে প্রাণীর মধ্যে ছিল এবং বাদুড় থেকে সরাসরি বা প্রাণীর মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করেছে।
২০২১ সালের সেল নামের জার্নালের গবেষণাপত্রে বিজ্ঞানীরা বলেন, করোনাভাইরাস হচ্ছে মানবদেহে ভাইরাস সংক্রমণের নবম ঘটনা। এর আগের সব ভাইরাসই প্রাণী থেকে উৎপত্তি হয়েছে।
গত বছর সায়েন্স নামের জার্নালে প্রকাশিত দুটি গবেষণায় প্রাণী থেকে ভাইরাসের উৎপত্তির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, সম্ভবত উহানের সামুদ্রিক খাদ্যের পাইকারি বাজার ছিল এই ভাইরাসের মূল উৎপত্তিস্থল। বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে এসেছেন, সম্ভবত দুটি ভিন্ন সময়ে ভাইরাসটি প্রাণী থেকে মানবদেহে সংক্রমিত হয়েছে।
অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী মাইকেল উরুবে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে বেশ কাজ করেছেন। তিনি বলেন, বিজ্ঞানসাহিত্যে যা বলা হয়েছে, তার সারমর্ম হচ্ছে এ রকম—প্রাকৃতিকভাবেই এ মহামারি ভাইরাসের উৎপত্তি হয়েছে।
উরুবে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত আরও স্বচ্ছ হওয়া এবং নতুন গোয়েন্দা তথ্য প্রকাশ করা, যা জ্বালানি বিভাগের প্রতিবেদনকে আরও সঠিকভাবে তুলে ধরে।
প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়া
প্রতিনিধি পরিষদে নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে কাজে লাগিয়ে করোনার উৎপত্তিসহ এই মহামারির সবদিক তদন্তে কাজ করছেন রিপাবলিকানরা। চলতি মাসের শুরুর দিকে তাঁরা তদন্তের অংশ হিসেবে অ্যান্থনি ফাউসি, জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক আভ্রিল হেইনেস, স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাভিয়ার বেচ্চেরাসহ বিভিন্ন কর্মকর্তার কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন।
রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট সরকারের আমলে সংক্রামক ব্যাধির শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করা ফাউসি (বর্তমানে অবসরে) রিপাবলিকানদের সমালোচনাকে ‘অর্থহীন’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
রিপাবলিকান পার্টির বিদেশসংক্রান্ত হাউস কমিটির চেয়ারম্যান মাইক ম্যাককল প্রতিবেদনের যাবতীয় বিষয় কংগ্রেসে উপস্থাপন করতে বাইডেন প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এ প্রতিবেদনের পক্ষে কী কী প্রমাণ রয়েছে, তা-ও জানাতে বলেছেন তিনি।
জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র কিরবি বলেন, প্রেসিডেন্ট বাইডেন বিশ্বাস করেন, আসলে কী ঘটেছিল, সেটা জানা, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের মহামারিকে প্রতিরোধ করা যায়। তবে এসব গবেষণা অবশ্যই নিরাপদ ও নিখুঁতভাবে করতে হবে। একই সঙ্গে বিশ্ববাসীর কাছে সেটা স্বচ্ছভাবে তুলে ধরতে হবে।
সর্বশেষ এফবিআইয়ের দাবি
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর (এফবিআই) পরিচালক ক্রিস্টোফার ওরে গতকাল মঙ্গলবার ফক্স নিউজকে বলেন, তাঁদের চলমান তদন্তের প্রাথমিক ফলাফল বিশ্লেষণে মনে হচ্ছে, চীনের উহানের গবেষণাগার থেকে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি হয়েছে।
ক্রিস্টোফার আরও বলেন, এফবিআই বিষয়টি নিয়ে আরও তদন্ত এবং মূল্যায়ন করছে। তিনি এ তদন্তে চীনের বিরুদ্ধে বাধা দেওয়ার অভিযোগ আনেন। তিনি বলেন, ‘আমার পর্যবেক্ষণ থেকে বলব, চীন এ তদন্ত ব্যাহত ও বিভ্রান্ত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। এটা সবার জন্য দুর্ভাগ্যজনক।’
এফবিআইয়ের এ মূল্যায়ন নতুন কিছু নয়। এর আগেও তারা বেশ আস্থার সঙ্গে বলেছিল, উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি থেকে দুর্ঘটনাক্রমে প্রথম করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে।
জ্বালানি বিভাগের গোপন প্রতিবেদন নিয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল প্রতিবেদন প্রকাশের পর এই প্রথম মার্কিন আইন প্রয়োগকারী কোনো সংস্থার প্রধান প্রকাশ্যে কথা বললেন। তবে করোনাভাইরাসের সত্যিকারের উৎস কখনো প্রকাশিত হবে কি না, তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে।