জে–৩৬: যুদ্ধক্ষেত্রে কতটা ভয়ংকর হতে পারে চীনের ‘রহস্যময়’ এই যুদ্ধবিমান

চীনের জে–৩৬ যুদ্ধবিমানছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের জাতির জনক মাও সে–তুংয়ের ১৩১তম জন্মবার্ষিকী ছিল গত ২৬ ডিসেম্বর। সেদিন দেশটির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রথমবারের মতো প্রকাশ পায় একই রকম দেখতে দুটি যুদ্ধবিমানের ভিডিও। ইন্টারনেটে তা ব্যাপক সাড়া ফেলে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভিডিওগুলোয় চীনের নতুন ষষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান ‘জে–৩৬’ দেখা গেছে।

যদিও এই যুদ্ধবিমান সম্পর্কে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি চীন সরকার। তবে দেশটির সামরিক বাহিনী বিমানটির বিষয়ে অন্যভাবে ইঙ্গিত দিয়েছে। খ্রিষ্টীয় বর্ষবরণের দিন সামরিক বাহিনীর ইস্টার্ন থিয়েটার কমান্ডের একটি ভিডিওতে ‘জিংকগো’ নামের একধরনের গাছের পাতার ছবি দেখা গেছে। ওই পাতা দেখতে অনেকটা নতুন যুদ্ধবিমানটির মতো।

চীন যে ষষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান তৈরি করছে, সামরিক বাহিনীর প্রকাশিত ভিডিওটিকে তার পরিষ্কার বার্তা বলে মনে করছেন সামরিক বিশেষজ্ঞরা। বিমানটিকে জে–৩৬ বলে উল্লেখ করেছেন তাঁরা। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, নতুন যুদ্ধবিমানটিতে যুগান্তকারী কিছু বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে। তবে যুদ্ধবিমানটি দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ করানোর জন্য কিছু ক্ষেত্রে ছাড়ও দেওয়া হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের বি–২১ বোমারু বিমানের সঙ্গে জে–৩৬–এর মিল রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা
ফাইল ছবি: এএফপি

যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর সাবেক পাইলট জন ওয়াটার্সের ভাষ্যমতে, যুদ্ধবিমানটির পেছনের দিকে কোনো পাখা নেই। এর ফলে সেটির রাডারের চোখ ফাঁকি দেওয়ার বা ‘স্টেলথ’–সক্ষমতা বাড়বে। তবে আকাশে বিভিন্ন কৌশলে সেটি চালানোর সক্ষমতা কমবে। নতুন যুদ্ধবিমানটিকে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমা বহনে সক্ষম ‘বি–২১ রাইডার’ বোমারু বিমানের সঙ্গে তুলনা করেছেন ওয়াটার্স। তিনি বলেন, বড় যুদ্ধবিমানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কৌশলে চালানোর সক্ষমতা কম থাকাটা কোনো সমস্যা নয়। কারণ সেগুলো ‘ডগফাইট’ বা আকাশে সরাসরি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেয় না।

কোনো কোনো বিশ্লেষকের ধারণা, ৪৫ হাজার কেজির বেশি ওজন নিয়ে আকাশে উড়তে পারবে জে-৩৬, যা মিগ-৩১-এর চেয়ে বেশি।

পাইলট ওয়াটার্সের সঙ্গে একমত নর্থরপ গ্রুম্যানের সাবেক কর্মকর্তা বিল সুইটম্যান। এই প্রতিষ্ঠান বি–২১ বোমারু বিমান তৈরি করেছে। তাঁর মতে, দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে খুব কাছ থেকে ডগফাইটের গুরুত্ব কমছে। জে–৩৬–এর মূল কাজ হবে, আকাশ, মাটি ও বিমানবাহী রণতরিতে থাকা যুদ্ধবিমান, জ্বালানি তেলবাহী উড়োজাহাজ ও সহায়তাকারী বিভিন্ন উড়োজাহাজের মতো শত্রুপক্ষের লক্ষ্যবস্তুগুলোয় হামলা চালানো।

রাশিয়ার তৈরি মিগ–৩১ যুদ্ধবিমান
ফাইল ছবি: রয়টার্স

জে–৩৬–এর বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে রাশিয়ার তৈরি মিগ–৩১ যুদ্ধবিমানের বেশ মিল রয়েছে বলে মনে করেন অস্ট্রেলিয়ার বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পিটার লেটন। মিগ–৩১ দূরবর্তী অঞ্চলে গিয়ে দ্রুতগতিতে হামলা চালাতে পারে। লেটন বলেন, জে–৩৬–এর চাকা থেকে এর ভার বহন করার সক্ষমতার প্রমাণ পাওয়া যায়। কোনো কোনো বিশ্লেষকের ধারণা, ৪৫ হাজার কেজির বেশি ওজন নিয়ে আকাশে উড়তে পারবে জে–৩৬, যা মিগ–৩১–এর চেয়ে বেশি।

পিটার লেটন বলেন, এই যুদ্ধবিমান অন্য যেসব ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে, তার মধ্যে রয়েছে—চীনের কৌশলগত বোমারু বিমানগুলো দূরবর্তী কোথাও গেলে সেগুলোর নিরাপত্তার জন্য সঙ্গে থাকা। চীনের যেসব স্থানের ভূপৃষ্ঠে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নেই, সেখানকার আকাশসীমার প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করতে পারবে যুদ্ধবিমানটি। আকাশে না উড়েও ধ্বংস করতে পারবে দূরের কোনো হুমকি।

জে–৩৬–এর নকশা দেখে সেটি ভারী অস্ত্রশস্ত্র বহন করতে পারে বলে মনে করছেন লু গুয়ো–ওয়েই। নৌবাহিনী নিয়ে ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণ দিয়ে থাকেন নিউজিল্যান্ডভিত্তিক এই বিশ্লেষক। তাঁর মতে এই যুদ্ধবিমান পিএল–১৭–এর মতো ক্ষেপণাস্ত্র বহন করতে পারে। সর্বোচ্চ ৪০০ কিলোমিটার দূরে আকাশে থাকা লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করতে পারে এই ক্ষেপণাস্ত্র। ভারী এসব অস্ত্র নিয়ে শব্দের চার গুণের (মার্ক–৪) বেশি গতিতে ছুটে চলতে পারবে বিমানটি।

লু গুয়ো-ওয়েই মনে করেন, সরাসরি সম্মুখযুদ্ধের চেয়ে বড় পরিসরে কাজ করার সম্ভাবনা বেশি জে–৩৬–এর। যুদ্ধক্ষেত্রে বিমানটি সম্মুখসারিতে থাকা ড্রোন, জে–২০ যুদ্ধবিমান ও জে–৩৫এ যুদ্ধবিমানের সঙ্গে একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করবে। এর মাধ্যমে প্রচলিত আকাশপথে যুদ্ধ আরও তথ্যভিত্তিক ও সমন্বিত হবে। এ ছাড়া জে–৩৬–এর অত্যাধুনিক রাডার জে–২০–এর চেয়ে দূর থেকে স্টেলথ (রাডারের চোখ ফাঁকি দিতে পারে) যুদ্ধবিমানগুলো শনাক্ত করতে পারবে। ফলে চীনের বিমানবাহিনীর শক্তি বাড়বে।