চীনে কমিউনিস্ট বিপ্লবের নায়ক মাও সে–তুংয়ের লড়াই

হুনান প্রদেশের শাওশান শহরে মাও সে–তুংয়ের ছবি হাতে কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থকেরাফাইল ছবি: রয়টার্স

চীনের মহাপ্রাচীর। ছেলেবেলায় বই–পুস্তকে আমরা কত পড়েছি বিশ্বের দীর্ঘতম এ প্রাচীরের কথা। চীনা রূপকথা–লোকগাথাগুলো পড়ে শৈশব কেটেছে আমাদের অনেকের। আধুনিক বিশ্বে সেই চীন আজ ভিন্ন পরিচয়ে পরিচিত। চীন এখন এক পরাশক্তির নাম—সামরিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তির বলে বলীয়ান। চীনের এ শক্তিশালী অবস্থানের পেছনে বড় ভূমিকা রয়েছে দেশটির ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির। এই দলের কথা বললে প্রথমেই যাঁর নাম আসে, তিনি মাও সে–তুং। দীর্ঘ বিপ্লবী ও সংগ্রামী পথ পাড়ি দেওয়ার পর ১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর পিপলস রিপাবলিক অব চায়না প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। ঘোষণা দেন চীনে কমিউনিস্ট শাসনের।

একেবারে গোড়া থেকে মাও সে–তুং সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের ফিরতে হবে শত বছর পেছনে—ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে। চীনে তখন চলছে কিং রাজবংশের শাসন। নড়বড়ে শাসনের কারণে তখন দেশটির অবস্থা বেহাল। তলানিতে অর্থনীতি। এমনই এক সময়ে ১৮৯৩ সালে হুনান প্রদেশের শাওশান শহরে এক কৃষক পরিবারে জন্ম মাওয়ের। চারদিকে আর্থিক সংকট চললেও তাঁর পরিবার ছিল বেশ সচ্ছল। আট বছর বয়সে গ্রামের স্কুলে পড়ালেখা শুরু করেন তিনি। তবে সে সময় বেশি দূর এগোতে পারেননি। বাবা তাঁকে ফিরিয়ে আনেন কৃষিকাজে। তখন তাঁর বয়স ১৩ বছর।

পরের বছরেই আরেক ধাক্কা। মাওয়ের বিয়ে ঠিক করেন তাঁর বাবা। যদিও ওই বিয়ে তিনি কখনোই মেনে নেননি। এরপর বয়স ১৭ বছর হলে বাড়ি ছাড়েন মাও। ভর্তি হন হুনান প্রদেশের রাজধানী চাংশার একটি স্কুলে। পরের বছর ১৯১১ সাল—রাজার শাসনের বিরুদ্ধে শুরু হলো ‘সিনহাই বিপ্লব’। সেই বিপ্লবে যোগ দিলেন মাও। নাম লেখালেন চীনের জাতীয়তাবাদী দল কুয়োমিনটাংয়ে। দলটির তখন নেতৃত্বে ছিলেন সান ইয়াত–সেন। ১৯১২ সালে বিপ্লবের মুখে রাজতন্ত্রের পতন হয়, প্রতিষ্ঠা হয় চীন প্রজাতন্ত্রের।

সমাজতন্ত্রের পথে

১৯১৮ সালে স্নাতক শেষ করেন মাও সে–তুং। সে বছরই তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়। সিদ্ধান্ত নেন আর বাড়ি ফিরবেন না। সে ভাবনা থেকেই রাজধানী বেইজিংয়ে পাড়ি জমান। তবে কপালের ফেরে কোনো চাকরি জোগাড় করতে পারেননি। অনেক চেষ্টা–তদবিরের পর অবশেষে বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিক লি দাজাওয়ের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। লি ছিলেন প্রাথমিক চীনা কমিউনিস্টদের একজন। তাঁর বিপ্লবী চিন্তাভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হন মাও। একসময় হাতে পান মার্ক্সবাদী চিন্তাধারার বইপত্র। পরিচিত হয়ে ওঠেন মার্ক্সবাদী হিসেবে। ১৯২১ সালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন মাও।

১৯৩৭ সালের জুলাই মাসে জাপানের রাজকীয় সেনাবাহিনী চীন আক্রমণ করে। বেইজিংসহ বেশ কিছু অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন কাইশেক। পালিয়ে যান বেইজিং ছেড়ে।

ধীরে ধীরে বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে কমিউনিস্ট পার্টি। দলের একটি বড় সমর্থক শ্রেণি সৃষ্টি হয়। এরই মধ্যে ১৯২৩ সালে তৎকালীন চীনের প্রেসিডেন্ট সান ইয়াত–সেন একটি নীতি হাতে নেন। ওই নীতিতে বলা হয়, দেশ পরিচালনায় কমিউনিস্ট পার্টিকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাবে তাঁর দল কুয়োমিনটাং। সে সময় কমিউনিস্ট পার্টি ও কুয়োমিনটং—দুই দলের প্রতিই মাও সে–তুংয়ের সমর্থন ছিল। একপর্যায়ে লেনিনবাদের দিকে ঝুঁকে যান তিনি। বিশ্বাস করতেন, এশিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চাবিকাঠি হলো কৃষকশ্রেণির সমর্থন।

লংমার্চ

১৯২৫ সালের মার্চে সান ইয়াত–সেনের মৃত্যু হয়। তাঁর জায়গায় কুয়োমিনটাং দলের প্রধান হন চিয়াং কাইশেক। তিনি পূর্বসূরি সান ইয়াত–সেনের চেয়ে অনেক বেশি রক্ষণশীল ছিলেন। ১৯২৭ সালে প্রেসিডেন্ট চিয়াং কাইশেক কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁর দলের জোট ভেঙে দেন। সমাজতন্ত্রের অনুসারীদের ওপর শুরু করেন দমন–পীড়ন। অনেককে হত্যা ও বন্দী করা হয়। এ সময় মাও সে–তুং কৃষকদের নিয়ে বিপ্লবী বাহিনী গঠন করেন, যা ‘রেড আর্মি’ নামে পরিচিত। এই বাহিনীকে শক্তিশালী করার মধ্য দিয়ে মাও সে–তুং ১৯৩০ সালে তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন চীনের দক্ষিণ-পশ্চিম জিয়াংজি অঞ্চলে সোভিয়েত রিপাবলিক অব চায়না সরকার গঠন করেন।

১৯৩৪ সালে জিয়াংজি প্রদেশের বেশ কিছু অঞ্চল মাওয়ের অধীন চলে আসে। চিয়াং কাইশেক প্রায় ১০ লাখ সেনা পাঠান মাওয়ের রেড আর্মিকে দমন করার জন্য। তাঁরা জিয়াংজি প্রদেশের পার্বত্য অঞ্চলে রেড আর্মিকে ঘিরে ফেলেন। তখন রেড আর্মি সেখান থেকে কৌশলে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। পরবর্তী ১২ মাসে এক লাখের বেশি কমিউনিস্ট ও তাঁদের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিরা চীনের উত্তরে ইয়ানান অঞ্চলের দিকে পাড়ি জমান। পথটি ছিল আট হাজার মাইল দীর্ঘ। এ যাত্রা শেষে টিকে ছিলেন মাত্র ৩০ হাজারের মতো কমিউনিস্ট নেতা–কর্মী। যাত্রাটি ‘লংমার্চ’ নামে পরিচিত।

বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে ১৯৬৭ সালে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের পরিদর্শনকালে মাও (মাঝে)
ফাইল ছবি: এএফপি

জাপান–চীন সংঘাত

কমিউনিস্টদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার পর বেশি দিন শান্তিতে থাকতে পারেননি চিয়াং কাইশেক। ১৯৩৭ সালের জুলাই মাসে জাপানের রাজকীয় সেনাবাহিনী চীন আক্রমণ করে। বেইজিংসহ বেশ কিছু অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন চিয়াং কাইশেক। পালিয়ে যান বেইজিং ছেড়ে। জাপানি বাহিনীকে ঠেকাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত তিনি কমিউনিস্টদের সঙ্গে সন্ধি করেন। কমিউনিস্ট ও কুয়োমিনটাং বাহিনী একসঙ্গে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। ওই সময়ে মাও সে–তুং নিজেকে চীনের সামরিক বাহিনীর প্রধান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয় হয়। এর মধ্য দিয়ে চীন জাপানের দখলকৃত অঞ্চল ফিরে পায়। তখন চীনে একটি জোট সরকার গঠনের চেষ্টা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। তবে একক নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পথে হাঁটেন মাও। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। মাও তাঁর কৌশলী নেতৃত্বের মাধ্যমে কুয়োমিনটাং বাহিনীকে পরাজিত করেন। ১৯৪৯ সাল নাগাদ পুরো চীন দখল করেন কমিউনিস্টরা। দলবল নিয়ে তাইওয়ানে পালিয়ে যান চিয়াং কাইশেক। সে বছরের ১ অক্টোবর বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন চত্বরে পিপলস রিপাবলিক অব চায়না প্রতিষ্ঠা করে কমিউনিস্ট শাসনের ঘোষণা দেন মাও সে–তুং।

পরবর্তী কয়েক বছরে চীনে বড় কিছু সংস্কার এনেছিলেন মাও সে–তুং। ভূস্বামীদের জমি জব্দ করে জনগণের সম্পত্তিতে পরিণত করেন। সে সময় চীনের নারীদের মর্যাদা বেড়েছিল, বৃদ্ধি পেয়েছিল শিক্ষার হার, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়াও মানুষের জন্য সহজতর হয়েছিল। তবে শহরাঞ্চলে তেমন সংস্কার আনতে পারেননি তিনি। এমন পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক ধারায় তিনি ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন তেমন একটা সমালোচনার মুখে পড়বেন না। তবে সে ধারণা ভুল ছিল। ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে শেষ পর্যন্ত তিনি দমনের পথে হাঁটেন। ভিন্নমত প্রকাশ করা হাজার হাজার মানুষকে তখন বন্দী করা হয়।

ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ

১৯৫৮ সালের জানুয়ারিতে ‘গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড’ নামের উদ্যোগ হাতে নেন মাও সে–তুং। এর উদ্দেশ্য ছিল, চীনে কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বাড়ানো। এ উদ্যোগের সঙ্গে কমবেশি ৭৫ হাজার কৃষককে যুক্ত করা হয়। তাঁদের প্রত্যেকের পরিবারকে কিছু জমি ও কৃষিকাজ থেকে লাভের অংশ দেওয়া হয়েছিল। মাও সে–তুং আশা করেছিলেন, এ উদ্যোগের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়িয়ে কয়েক দশকের মধ্যে চীনকে শত বছর এগিয়ে নেওয়া যাবে। প্রথম দিকে কিছুটা সফলও হয়েছিলেন তিনি। তবে তিন বছর ধরে চলা বন্যা ও খারাপ ফসলের কারণে পরিস্থিতি বদলে যায়।

এক বছরের মধ্যে চীনে দেখা দেয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। ধারণা করা হয়, ১৯৫৯ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত দেশটিতে প্রায় চার কোটি মানুষের মৃত্যু হয়।

এক বছরের মধ্যে চীনে দেখা দেয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। ধারণা করা হয়, ১৯৫৯ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত দেশটিতে প্রায় চার কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড উদ্যোগের ব্যর্থতার কারণে মাও সে–তুং কোণঠাসা হয়ে পড়েন। দেশের নিয়ন্ত্র্রণ নিয়ে নেন তাঁর বিরোধীরা। এরপর মাও যখন আবার ক্ষমতায় ফেরার অপেক্ষায় ছিলেন, তখন তাঁর কিছু লেখালেখি একত্র করেন লিন বিয়াও নামের এক ভক্ত। ওই লেখাগুলোই পরে পরিচিতি পায় ‘লিটল রেড বুক’ নামে।

১৯৬১ সালে চীনের লুশান পর্বতে অবকাশযাপনকালে মাও
ফাইল ছবি: এএফপি

‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’

১৯৬৬ সালে আবার সামনে আসেন মাও সে–তুং। তখন তাঁর বয়স ৭৩ বছর। শুরু করেন সাংস্কৃতিক বিপ্লব। সে বছর মে মাসে চীনের ইয়াংতজে নদীর তীরে এক সমাবেশে তাঁকে দেখা যায়। তিনি কয়েক মিনিট ধরে নদীতে সাঁতার কাটেন। বিরোধীদের প্রতি যেন তাঁর বার্তা ছিল—‘দেখ, আমি ফিরে এসেছি।’ পরে চীনজুড়ে বেশ কয়েকটি সভা–সমাবেশ করেন মাও সে–তুং। এতে অংশ নেন হাজার হাজার তরুণ। মাওয়ের হিসাব ছিল এমন—গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড উদ্যোগে তাঁর ব্যর্থতা ও দুর্ভিক্ষের কথা তরুণেরা মনে রাখবেন না। ওই হিসাবও মিলেছিল।

মাও সে–তুং তাঁর সমর্থকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, চীনে আবার পুঁজিবাদ ফিরিয়ে আনতে সমাজে বুর্জোয়া উপাদান ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব উপাদানের মূলোৎপাটন করতে হবে। তাঁর তরুণ সমর্থকেরা রেড গার্ডস নামের বাহিনী গঠন করেন। এই বাহিনীর নেতৃত্বে চলে সাংস্কৃতিক বিপ্লব। মাও আবার ক্ষমতায় ফেরেন। এর পর থেকে আমৃত্যু কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৭৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর আজকের এই দিনে ৮২ বছর বয়সে মৃত্যু হয় তাঁর। তাঁর আদর্শ নিয়েই এগিয়ে চলছে চীন। মাও সে–তুংকে বলা হয় আধুনিক চীনের রূপকার।

তথ্যসূত্র: বিবিসি, আল–জাজিরা, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইট, প্রথম আলো