সির নেতৃত্বে চীনের সামরিক বাহিনীর আমূল বদল

মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর বলেছে, সামরিক শক্তিতে চীনই এখন তাদের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী
ছবি: রয়টার্স

চীনে এক দশক ধরে ক্ষমতায় সি চিন পিং। এই সময়ে চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় নৌবাহিনী গঠন করেছে, দেশটির সেনাবাহিনী হয়ে উঠেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড়, পারমাণবিক ও ব্যালিস্টিক অস্ত্রের বড় মজুত বানিয়েছে। চীনের এই সামরিক সক্ষমতা বিশ্বের যেকোনো প্রান্তেই দেশটির শত্রুপক্ষের জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ।

চীনের প্রতিবেশী দেশগুলোও যত দ্রুত পারা যায় অস্ত্রের মজুত বাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। এর মধ্যেই আগামী পাঁচ বছরের মেয়াদে সি চিন পিং ফের দেশটির ক্ষমতায় আসছেন। সামরিক বিশ্লেষকদের ধারণা, এই সময়ে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে সমরাস্ত্রের প্রতিযোগিতা আরও বড় আকার ধারণ করবে।

সামরিক সক্ষমতা বাড়িয়ে তোলার প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে নেই চীনের প্রতিবেশীরাও। একদিকে দক্ষিণ কোরিয়া ‘ব্লু–ওয়াটার’ নামে নৌবাহিনীকে ঢেলে সাজাচ্ছে অপর দিকে অস্ট্রেলিয়া পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন কিনছে। সাম্প্রতিক সময়ে এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে অস্ত্র কেনায় একটা বড় উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে।

লন্ডনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিকের হিসাবে, শুধু গত বছরে এশিয়া–প্যাসিফিকের দেশগুলোর প্রতিরক্ষা ব্যয় এক ট্রিলিয়ন (এক লাখ কোটি) ডলার ছাড়িয়ে গেছে। চীন, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম গত এক দশক তাদের সামরিক ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ করেছে। দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত ও পাকিস্তানও পিছিয়ে নেই। এমনকি জাপানও প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দের রেকর্ড গড়েছে। একই সঙ্গে কোনো পরিস্থিতিতে ‘কাউকে আগে আক্রমণ না করার’ নীতি থেকে সরে এসেছে জাপান।

সি চিন পিংয়ের এক দশকের শাসনামলে সামরিক শক্তিতে অনেক অগ্রগতি করেছ চীন
ছবি: রয়টার্স

অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা ও দেশটির অস্ট্রেলিয়ান স্ট্র্যাটেজিক পলিসি ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যুক্ত ম্যালকম ড্যাভিস বলেন, চীনের সামরিক আধুনিকায়নের সঙ্গে তাল মেলাতে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বড় বড় দেশগুলোও একই পথে হাঁটছে। শুধু হাঁটছেই না, যত দ্রুত সম্ভব সামরিক সক্ষমতা বাড়াচ্ছে তারা।

বছরের পর বছর চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মিকে (পিএলএ) দুর্বল অস্ত্রের অকার্যকর বাহিনী হিসেবে দেখা হতো। একজন ইতিহাসবিদ পিএলএ–কে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামরিক জাদুঘর অভিহিত করেন। তখন চীনা অস্ত্রের বেশির ভাগ সোভিয়েত জমানার। সঙ্গে ছিল দুর্নীতি আর পদাতিক বাহিনীর ওপর নির্ভরশীলতা।

পিএলএ কোরীয় যুদ্ধে অংশ নেওয়ায় প্রায় দুই লাখ চীনা নাগরিককে প্রাণ হারাতে হয়। ১৯৭৯ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধেও চীনের আরও কয়েক হাজার মানুষ মারা যান। সেই ইতিহাসও অনেকটা বদলে দেওয়া হয়েছে। ২০১৩ সালে সি চিনপিং যখন পিএলএর ‘কমান্ডার–ইন–চিফ’ হলেন, তখন থেকে এই সংস্কার শুরু হয়।

স্টকহোম পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের হিসাবে, টানা ২৭ বছর ধরে চীনের প্রতিরক্ষা খাতের বরাদ্দ বেড়েই চলেছে। এখন চীনের অস্ত্রাগারে রয়েছে দুটি বিমানবাহী রণতরি, দূর ও স্বল্পপাল্লার কয়েক শ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, হাজার হাজার যুদ্ধবিমান। এ ছাড়া দেশটির বর্তমান নৌবাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীকে ছাড়িয়ে গেছে।

মার্কিন কংগ্রেসের স্পিকারের সফরের প্রতিক্রিয়ায় গত আগস্টে চীন সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য তাইওয়ান আংশিক ঘিরে ফেলার পরে যুক্তরাষ্ট্রের একজন শীর্ষস্থানীয় সামরিক কর্মকর্তা স্পষ্টতই বলেছেন, চীনের যে সামরিক সক্ষমতা, সত্যিকার অর্থে তাদের ঠেকানোর কাজটি হবে অত্যন্ত দুরূহ, এমনকি সেটা ওয়াশিংটনের জন্যও।

যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের কমান্ডার কার্ল থমাস সংবাদমাধ্যমকে বলেন, তাদের (চীন) আছে বিশাল এক নৌবাহিনী। চাইলে অনেক কিছু করতে পারে তারা।

মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী শুধু প্রচলিত অস্ত্র নয়, চীনের পারমাণবিক অস্ত্রের মজুতও দিন দিন বেড়ে চলেছে। চীনের কাছে যেসব পারমাণবিক অস্ত্র আছে, তারা চাইলে জল, স্থল ও আকাশপথে সেই অস্ত্র দিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। এত দিন এ সক্ষমতা ছিল শুধু যুক্তরাষ্ট্রের। এখন চীনের সে সক্ষমতা আছে। বুলেটিন অব অটোমিক সায়েন্টিস্টের দেওয়া হিসাবে, চীনের কাছে ৩৫০টি পারমাণবিক অস্ত্র আছে, যা স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ।      

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাদের ধারণা, ২০২৭ সালের মধ্যে চীনের পারমাণবিক অস্ত্রের মজুত বেড়ে দ্বিগুণ তথা ৭০০ ছাড়িয়ে যাবে। চীনের উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম নতুন ক্ষেপণাস্ত্রের মজুত গড়ে তোলার কাজ চলছে। চীনের সামরিক শক্তি ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে এটা পেন্টাগনের কোনো ‘খোঁচা’ নয়।

গত বছর এক প্রতিবেদনে পেন্টাগন বলে, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, সামরিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষমতার দিকে চীনই একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী। এটা স্থিতিশীল ও মুক্ত একটি বিশ্বব্যবস্থার জন্য বড় চ্যালেঞ্জও বটে। জাতীয় স্বার্থ ও কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার মাধ্যমে বেইজিং পুরো বিশ্বব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।