২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

পুলিশের ছবি তুলে ১৪০০ দিন বন্দী

তাইওয়ানের নাগরিক লি মেং-চু
ছবি: এএফপি

‘পাসপোর্ট পরীক্ষার পর আমি খুব স্বস্তি পাচ্ছিলাম। আমি খানিকটা কেঁদেছিলাম। আমি মুক্ত পৃথিবীতে ফিরে এসেছি।’

বিবিসিকে এই কথাগুলো বলছিলেন লি মেং-চু। তাইওয়ানের নাগরিক তিনি। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছেন চীনের কারাগার থেকে। তবে এর আগে লিকে চীনে আটক থাকতে হয়েছে ১ হাজার ৪০০ দিনের বেশি। লির অপরাধ, তিনি চীনের পুলিশের ছবি তুলেছিলেন। এ কারণে তাঁর বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি ও রাষ্ট্রীয় গোপন নথি চুরির অভিযোগ আনা হয়।

লি আসলে কী করেন, তা সবিস্তার জানা যেতে পারে। তাইওয়ানের এই নাগরিক মূলত ব্যবসায়ী। বহুবার তিনি চীনে গিয়েছেন। একসময় তিনি চীনে কাজও করতেন। দেশটির জিয়াংসু প্রদেশের সুঝৌ শহরে থাকতেন। এ ছাড়া বছরে দুবার তিনি চীন যান। কিন্তু একটি প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানের কাজে ২০১৯ সালের আগস্টে শেষবার তিনি যখন চীনে গিয়েছিলেন, তখন পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। সেই সময় হংকংয়ের গণতন্ত্রকামীরা আন্দোলন করছিলেন। বলা হয়, এই আন্দোলন হংকংয়ের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আন্দোলন। কারণ, ওই সময় প্রায় প্রতি সপ্তাহে পুলিশ–বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হচ্ছিল।

যাহোক, এই বিক্ষোভের প্রতি তাইওয়ানের সমর্থন ছিল। লির নিজেরও ওই বিক্ষোভে সমর্থন ছিল। এ জন্য কৌতূহল থেকে সেই সময় হংকং গিয়েছিলেন। অল্প কিছুক্ষণের জন্য সেখানে ছিলেন। এ সময় একটি মিছিল তাঁর পাশ দিয়ে যায়। এই মিছিলকারীদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে তিনি একটি লিফলেট তাঁদের দিয়েছিলেন। এরপর তিনি চীনের মূল ভূখণ্ড শেনঝেনে চলে যান তাঁর এক সহকর্মীর সঙ্গে দেখা করতে।

তত দিন আমি চীনের বলিতে পরিণত হয়েছি। পরিবার, পরিচিতজনেরা যখন আমাকে অনেকটা একঘরে করে ফেলল, তখন নিজে আরেকবার বলির পাঁঠা মনে হলো
লি মেং-চু

শেনঝেনে গিয়ে একটি ঘটনা দেখেন লি। তিনি দেখেন, শেনঝেন স্টেডিয়ামে শত শত পুলিশ সদস্য জড়ো হচ্ছেন এবং সাঁজোয়া যান সেখানে আনা হয়েছে। ওই সময় অনেকেই এটা ভেবে ভয় পাচ্ছিলেন যে নিরাপত্তা বাহিনীর এসব সদস্যকে হংকংয়ে পাঠানো হবে বিক্ষোভ দমনের জন্য। এই পুলিশ সদস্যদের স্টেডিয়ামে জড়ো হওয়ার দৃশ্য লি হোটেলকক্ষের জানালা দিয়ে দেখেছিলেন। এরপর তিনি সেখানে গিয়ে এর ছবি তুলেছিলেন। লি বলেন, সেখানে কোনো সতর্কসংকেত দেওয়া হয়নি। অনেকেই সেখানে ছবি তুলছিলেন। পুলিশের যে বেষ্টনী, তা–ও তিনি অতিক্রম করেননি।

লি বলেন, তিনি কোনো ধরনের গুপ্তচরবৃত্তির সঙ্গে জড়িত নন। তিনি বলেন, ‘আমি শুধু আমার কৌতূহল থেকে সেখানে গিয়েছিলাম। সেখানে পুলিশদের জড়ো করার বিষয়টি যদি রাষ্ট্রীয় কোনো গোপন কাজই হতো, তাহলে সবকিছু কেন হোটেল থেকে দেখা গেল।’

লি যখন শেনঝেন থেকে তাইওয়ানে ফিরছিলেন, তখনই বিপত্তিটা হয়। বিমানবন্দরে তাঁকে থামিয়ে দেওয়া হয়। এরপর তার ব্যাগ ও মুঠোফোনে তল্লাশি চালানো হয়। এ সময় তাঁর ব্যাগে লিফলেট পাওয়া যায় এবং মুঠোফোনে ছবি পাওয়া যায়। এরপর চীনের জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে একটি হোটেলে আনেন। ওই হোটেলে তাঁকে আটকে রাখা হয় ৭২ দিন। ওই দিনগুলোয় তিনি ঘর থেকে বের হতে পারেননি। তাঁকে টেলিভিশন দেখতে দেওয়া হয়নি, কোনো সংবাদপত্র তাঁকে পড়তে দেওয়া হয়নি, ওই ঘরের জানলার পর্দা তোলা তাঁর জন্য নিষেধ ছিল। এমনকি কথা বলাও তাঁর জন্য নিষেধ ছিল। ওই সময় তিনজন তাঁর ওপর নজর রাখতেন।

লি বলেন, ‘আমি আসলে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অপেক্ষা করতাম প্রতিদিন। কারণ, ওই সময় ছাড়া আমার কথা বলার সুযোগ ছিল না। আমার কিছু করার ছিল না। প্রতিদিন মেঝে মুছতাম, বিছানার নিচের জায়গাটা পরিষ্কার করতাম, সিলিং পরিষ্কার করতাম। এটা খুবই যন্ত্রণাদায়ক ছিল।’

যে ছোট্ট কক্ষে তাঁকে রাখা হয়েছিল, সেখানে আরও ১৫ জন থাকতেন। সেখানে কষ্ট হলেও তাঁর জন্য খানিকটা স্বস্তির ছিল। কারণ, সেখানে তিনি অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন। তবে ওই গুয়াংডং কারাগারে লিকে কাজ করতে হতো। সেই কাজ ঠিকমতো করতে না পারলে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হতো।

লির কথা সঙ্গে চীনের অধিকারকর্মীদের বক্তব্য মিলে যায়। তাঁরা বলছেন, জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে—এমন অপরাধে কোনো ব্যক্তিকে আটক করলে ওই ব্যক্তিকে এভাবেই গোপন স্থানে আটক করে রাখা হয়। কোনো বিচার ছাড়াই এভাবে মাসের পর মাস আটক রাখা হয় তাদের।

লির ক্ষেত্রেও এটা ঘটেছে। পরে তাঁকে একটি আটক কেন্দ্রে নেওয়া হয়। এরপর একসময় লিকে টেলিভিশনে দেখা যায়। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে তাঁকে বলতে শোনা যায়, মাতৃভূমির ক্ষতি করায় তিনি দুঃখিত।

এ বিষয়ে লি বলেন, তাঁর ধারণা ছিল, ভুল স্বীকার করলে তিনি হয়তো দ্রুত মুক্তি পাবেন।
কিন্তু তা হয়নি। এরপর লির বিচার শুরু হয়। বিচারে তাঁর ১ বছর ১০ মাস কারাদণ্ড হয়। অভিযোগ, বেআইনভাবে রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য পাচার এবং বিদেশি গুপ্তচর হিসেবে কাজ করা। এই ঘটনার খবর রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে অতিরঞ্জিত করে প্রচার করা হয়। এতে বলা হয়, লি ওই স্টেডিয়াম থেকে ছবি তুলেছিলেন তাইওয়ানের বিভিন্ন গ্রুপের কাছে পাঠানোর জন্য। তিনি তাইওয়ানের স্বাধীনতাকামী।

লি ছিলেন গুয়াংডং কারাগারে। যে ছোট্ট কক্ষে তাঁকে রাখা হয়েছিল, সেখানে আরও ১৫ জন থাকতেন। সেখানে কষ্ট হলেও তাঁর জন্য খানিকটা স্বস্তির ছিল। কারণ, সেখানে তিনি অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন। তবে ওই গুয়াংডং কারাগারে লিকে কাজ করতে হতো। সেই কাজ ঠিকমতো করতে না পারলে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হতো।

যাহোক, কারাভোগ শেষে লির দেশে ফেরার কথা। কিন্তু মুক্তি পাওয়ার এক মাস আগে তিনি জানতে পারেন, আগামী দুই বছর তিনি চীনের মূল ভূখণ্ড ছাড়তে পারবে না। এ প্রসঙ্গে অধিকারকর্মী ইয়াকিউ ওয়াং বলেন, চীন সরকার আসলে এটা দেখাতে চাইছিল যে লি আসলে চীনের নাগরিক।

লির মতো অনেকের ক্ষেত্রেই এমনটা হয়। তবে এটা ঠিক বলা কঠিন, তাইওয়ানের কতজন চীনে এমন বন্দী অবস্থায় আছেন। যদিও এটা অনুমান করা যায়, চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হতে থাকায় ‘জাতীয় নিরাপত্তাঝুঁকিতে’ ফেলার অভিযোগে লির মতো গ্রেপ্তার হওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। আর লির সঙ্গে ঘটে যাওয়া এ ঘটনা থেকে এটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তাইওয়ানের যাঁরা গ্রেপ্তার হচ্ছেন, তাঁদের প্রতি কঠোর হচ্ছে চীন।

যাহোক, আবারও লির কথায় ফেরা যাক। লি ২০২১ সালে জুলাইয়ে মুক্তি পান। এই সময় চীনের পুলিশ তাঁর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করে। পরে তিনি সাংহাই হয়ে তাইওয়ানের ফেরার চেষ্টা করেন। কিন্তু অভিবাসন কর্মকর্তারা তাঁকে আটকে দেন। এরপর লি বুঝতে পারেন, তিনি আসলে পুলিশের নজরদারিতে আছেন।

লি যখন বুঝতে পারেন তিনি আসলে চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে বের হতে পারবেন না, তখন তিনি ১০০টা শহর ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এরপর এক নিঃসঙ্গতার মুখোমুখি হন লি। কারণ, পরিবারের লোকজন তাঁর সঙ্গে যোগযোগ কমিয়ে দেয় এটা ভেবে যে তিনি আবারও বিপদে পড়তে পারেন। লি পরিচিত ব্যবসায়ীরাও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দেয়। ওই ব্যবসায়ীদের ভয় ছিল, লির কারণে তাঁরা বিপদে পড়তে পারেন। লি বলেন, ‘তত দিন আমি চীনের বলিতে পরিণত হয়েছি। পরিবার, পরিচিতজনেরা যখন আমাকে অনেকটা একঘরে করে ফেলল, তখন নিজে আরেকবার বলির পাঁঠা মনে হলো।’

লির জীবন এরপর বদলে যায়। তিনি চীনের নাগরিকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। এর মধ্যে আইনজীবী যেমন ছিলেন, তেমনি অধিকারকর্মীও ছিলেন। অনেকেই তাঁর প্রতি সদয় হন। তাঁকে থাকার বন্দোবস্তও করে দেন।

লি জাপান হয়ে তাইওয়ানে ফিরছেন। চীন সম্পর্কে তাঁর যে ধারণা আগে ছিল, তা বদলে গেছে।