শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাজাপক্ষের ফিরে আসার সম্ভাবনা
শ্রীলঙ্কায় নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আজ শনিবার ভোট দিচ্ছেন দেশটির ভোটাররা। আজকের এ নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে পাঁচ বছর পর প্রেসিডেন্ট পদে রাজাপক্ষে বংশের প্রত্যাবর্তন ঘটতে পারে। জনমত জরিপ নিষিদ্ধ হলেও সব প্রার্থীর মধ্যে এগিয়ে রয়েছেন সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী গোতাবায়া রাজাপক্ষে ও বর্তমান সরকারের আবাসনবিষয়ক মন্ত্রী সাজিথ প্রেমাদাসা। খবর এএফপির।
প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ মাহিন্দা রাজাপক্ষে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তাঁর ছোট ভাই গোতাবায়া রাজাপক্ষে তাঁদের দল ফ্রিডম পার্টির শীর্ষ পদে রয়েছেন। তামিল টাইগারদের প্রতিহত করে সমর্থকদের ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছেন সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী গোতাবায়া রাজাপক্ষে (৭০)। তবে যুদ্ধাপরাধ, দুর্নীতি ও চীনকে সমর্থন দিয়ে তিনি সমালোচকদের নিন্দার মুখে পড়েছেন। এপ্রিল মাসে ইসলামি চরমপন্থীদের হামলায় ২৬৯ জন নিহত হওয়ার প্রেক্ষিতে তিনি দেশের নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ নিহত সাবেক প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমাদাসার ছেলে ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির (ইউএনপি) প্রধান সাজিথ প্রেমাদাসা (৫২)। তিনি দেশবাসীর নিরাপত্তা ও উন্নয়নের পাশাপাশি দরিদ্র নারীদের মধ্যে বিনা মূল্যে স্যানিটারি প্যাড বিতরণের ওপরও জোর দিয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর প্রথম দিকে জনপ্রিয়তায় এগিয়ে ছিলেন গোতাবায়া। কিন্তু সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ভোটারদের মন জয় করতে সক্ষম হন সাজিথ।
ভোট শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ জানিয়েছে, উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে সংখ্যালঘু মুসলিম ভোটারদের বহন করা বাসের একটি বহরে বন্দুকধারীরা গুলি ছুড়েছে।
বন্দুক হামলার ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। তবে পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, হামলাকারীরা শতাধিক বাসের বহরটিতে হামলা চালানোর সময় টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করা হয়।
কলম্বো থেকে ২৪০ কিলোমিটার উত্তরে টানটিরিমালে শহরের এক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বন্দুকধারীরা গুলি চালিয়েছে, পাথর ছুড়েছে। তিনি বলেন, কমপক্ষে দুটি বাসে হামলা চালানো হয়। তবে কেউ হতাহত হয়েছে বলে জানা যায়নি।
শ্রীলঙ্কায় চলতি বছরের অনেকটা সময়জুড়ে ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা। প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা ও প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের মধ্যে দ্বন্দ্বই ছিল এই সংকটের মূল কারণ। এর মধ্যেই ঘটে যায় দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ধরনের জঙ্গি হামলা। গত এপ্রিলে ইস্টার সানডের দিনে একযোগে কয়েকটি গির্জা ও হোটেলে চালানো হামলায় নিহত হন আড়াই শর বেশি মানুষ। সবকিছু পেছনে ফেলে লঙ্কানরা নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে আজ ভোট দিচ্ছেন। নির্বাচনে প্রধান দুই প্রার্থীর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া গেছে।
এবারের নির্বাচনে রেকর্ড গড়ে লড়ছেন মোট ৩৫ জন প্রার্থী। স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে সাতটা থেকে ভোট গ্রহণ শুরু হয়েছে। একটানা বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত চলবে ভোট গ্রহণ। বড় ব্যবধানে কেউ জয়ী হলে কাল রোববার মধ্যাহ্নের দিকে ফলাফল হাতে চলে আসবে। নির্বাচন কর্মকর্তারা জানান, ৮৫ হাজার পুলিশ মোতায়েন করে নির্বাচনে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা এই নির্বাচনকে ‘একেবারে ভারসাম্যপূর্ণ নির্বাচন’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তার মানে, নির্বাচনে এই দুই প্রার্থীর যে কেউ জিততে পারেন।
নির্বাচন কমিশনপ্রধান মাহিন্দা দেশপ্রিয়া বলেছেন, ‘ভোটারদের কাছে আমার আবেদন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভোট দিতে যেতে হবে।’
ইস্টার সানডেতে হামলার পর শ্রীলঙ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি ও সংখ্যালঘু মুসলমানদের মধ্যে তুমুল উত্তেজনার মধ্যেই এবারের এই নির্বাচন হতে চলেছে। এ ছাড়া ২৬ বছর আগে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা তামিল বিদ্রোহীদের ওপর শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর চালানো নৃশংসতার ঘটনার বিচারের আশায় এখনো প্রহর গুনছে তামিলরা। জাতিসংঘের প্যানেল জানিয়েছে, তামিলদের বিরুদ্ধে চালানো ওই অভিযানে ৪০ হাজারের মতো মানুষ নিহত হন।
১ কোটি ৬০ লাখ ভোটার ৩৫ প্রার্থীর মধ্যে থেকে একজনকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নেবেন। প্রেসিডেন্ট হতে হলে একজন প্রার্থীকে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেতে হবে।
গোতাবায়া রাজাপক্ষের প্রধান টার্গেট সিংহলি বৌদ্ধদের সমর্থন। দেশটির ২ কোটি ২০ লাখ মানুষের ৭০ শতাংশই বৌদ্ধ। সাজিথ প্রেমাদাসার সমর্থন সিংহলিদের মধ্যে কম। তামিল ও মুসলমানরা তাঁকে সমর্থন দিচ্ছেন। তিনি বিনা মূল্যে আবাসন, শিক্ষার্থীদের পোশাক, নারীদের স্যানিটারি প্যাড প্রদানসহ গুরুত্বপূর্ণ নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটারদের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর নির্বাচনী সমাবেশে নারীদের উপস্থিতি বেশি দেখা গেছে। তাঁরা দুজনই শ্রীলঙ্কার রাজনীতিকে ভারসাম্য রাখতে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও চীন দুই দেশের সঙ্গেই অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে দেশ দুটির বিরুদ্ধে।
রাজাপক্ষে ও তাঁর পরিবারকে চীনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে ভাবা হয়। তামিলদের গুঁড়িয়ে দেওয়ার অভিযানে চীনের নিরঙ্কুশ সমর্থন পেয়েছিল তৎকালীন রাজাপক্ষে সরকার। গোতাবায়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নিপীড়ন বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।