রাশিয়ার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ অবস্থান নেওয়ায় জাপানকে ধন্যবাদ যুক্তরাষ্ট্রের

দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন জো বাইডেন ও ফুমিও কিশিদা
ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তিন দিনের সফরে জাপানের টোকিওতে অবস্থান করছেন। দক্ষিণ কোরিয়া সফর শেষ করে গতকাল রোববার বিকেলে টোকিওর কাছে ইওকোতা বিমান ঘাঁটিতে পৌঁছান বাইডেন। আজ সোমবার ছিল তাঁর কর্মব্যস্ত দিন।

সম্রাটের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে দিনের কর্মসূচি শুরু হয় বাইডেনের। সাক্ষাতকালে মার্কিন জনগণের পক্ষ থেকে জাপানের সম্রাটকে অভিনন্দন জানান বাইডেন। এ সময় নাগরিক পর্যায়ের মৈত্রীর ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত জাপান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের সুদৃঢ় অবস্থানের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তাঁরা।

সোমবারের এ সাক্ষাতে সম্রাট নারুহিতো বেশ কিছু সময় ধরে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলেন। ২০১৯ সালের মে মাসে নারুহিতো সিংহাসনে আরোহণ করার পর তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা দ্বিতীয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট হলেন বাইডেন।

সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাতের পর জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার সঙ্গে বৈঠকে বসেন বাইডেন। এর আগে টোকিওর আকাসাকা প্রাসাদে বাইডেনকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানান কিশিদা। এ সময় জাপানের আত্মরক্ষা বাহিনীর বিশেষ একটি দল বাইডেনকে গার্ড অব অনার প্রদান করে।

অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানের পর দেওয়া সংক্ষিপ্ত ভাষণে কিশিদা বলেন, প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণের পর এশিয়ায় প্রথম সফরে বাইডেনকে স্বাগত জানাতে পেরে তিনি উৎফুল্ল।

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র-জাপান মৈত্রীকে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের শান্তি ও সমৃদ্ধির একটি প্রধান ভিত্তি হিসেবে আখ্যা দেন বাইডেন। এছাড়া রাশিয়ার অভিযানের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ অবস্থান গ্রহণের জন্য জাপানকে ধন্যবাদ দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। আনুষ্ঠানিকতা শেষে দুই নেতা শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হন।

জাপানের স্থানীয় সময় বেলা ১১টায় শুরু হওয়া বৈঠক তিন পর্বে অনুষ্ঠিত হয়; যা চলে ২ ঘণ্টা ১৫ মিনিট। শুরুতে দুই নেতা একান্তে বসে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোর ওপর আলোকপাত করেন। এরপর ছোট আকারের গ্রুপ পর্যায়ের বৈঠকে আরও বিস্তারিত বিষয়ে আলোচনা করা হয়। সবশেষে যৌথ বিবৃতিসহ আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো চিহ্নিত ও চূড়ান্ত করা হয় মধ্যাহ্নভোজে।

শীর্ষ বৈঠকের পর জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ সম্মেলনে বৈঠকের মূল্যায়ণ নিয়ে জাপানের অবস্থান তুলে ধরেন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ এক কর্মকর্তা। জাপানের পক্ষ থেকে তিনটি দিকে আলোচনা চালানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল।

জাপান সফর নিয়ে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন
ছবি: রয়টার্স

সেগুলো হচ্ছে—আন্তর্জাতিক সমস্যাবলী, আঞ্চলিক পরিস্থিতি ও দুই নেতার ব্যক্তিগত সম্পর্কে এগিয়ে নেওয়া। আন্তর্জাতিক সমস্যার ক্ষেত্রে ইউক্রেন পরিস্থিতির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। আঞ্চলিক পরিস্থিতির ক্ষেত্রেও ইউক্রেনে রাশিয়ার চালানো হামলার পরোক্ষ উদ্ধৃতি টেনে শক্ত বার্তা দেওয়া হয় যে, একতরফাভাবে স্থিতাবস্থা বদলে ফেলে বিশ্বের যেকোনো অঞ্চলে এমন কোনো চেষ্টা মেনে নেওয়া হবে না। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা চীনের ওপর যে সম্ভাব্য প্রভাব ফেলতে পারে তা নিয়ে দুই দেশের উদ্বেগ এর মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে।

তাইওয়ান প্রণালীতে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে শীর্ষ বৈঠকে আলোচনা হলেও উভয় পক্ষ নিশ্চিত করেছে যে, তাইওয়ান প্রসঙ্গে মৌলিক অবস্থান পাল্টাচ্ছে না তারা। পূর্ব চীন সাগরে জাপানের কয়েকটি দ্বীপকে কেন্দ্র করে চীনের সঙ্গে দেখা দেওয়া উত্তেজনা নিয়েও দুই নেতা মতবিনিময় করেন।

উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ও পরমাণু পরীক্ষা নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানের এ দুই নেতা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। পাশাপাশি পিয়ংইয়ংয়ের পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের প্রয়োজনীয়তার কথা পুনরায় ব্যক্ত করেন তাঁরা। অপরদিকে, উত্তর কোরিয়ার জাপানি নাগরিক অপহরণ সমস্যা সমাধান করতে জাপানকে সহায়তার অঙ্গীকার করেন বাইডেন। একইসঙ্গে আঞ্চলিক নিরাপত্তার অবনতি হতে থাকায় জাপানের প্রতিরক্ষা সামর্থ জোরদারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন দুই নেতা।

টোকিওর একটি নৈশভোজে বাইডেনকে স্বাগত জানান জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা ও তাঁর স্ত্রী ইউকো কিশিদা
ছবি: রয়টার্স

বৈঠকের পর প্রচারিত যৌথ বিবৃতিতে শীর্ষ বৈঠকে চলা আলোচনার বিভিন্ন দিকের ফলাফল তুলে ধরা হয়। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পরিস্থিতিতে দুই দেশের যৌথ বিভিন্ন পদক্ষেপের বিস্তারিত বর্ণনাও তুলে ধরা হয় এতে। পাশাপাশি করোনা মহামারি সমস্যা সামাল দেওয়া, বিশ্বজুড়ে খাদ্য ঘাটতি মোকাবিলায় দুই দেশের সম্ভাব্য পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করা হয়। এছাড়া জাতিসংঘের সংস্কার বিষয়েও সুস্পষ্ট কিছু ধারণা দেওয়া হয়েছে।

বৈঠক শেষে দুই নেতা এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন। এ সময় কিশিদা বলেন, ভৌগোলিক অবস্থানের ওপর গুরুত্বারোপ না করে বলপূর্বক স্থিতাবস্থা বদল করে নেওয়ার যেকোনো চেষ্টা কোনো অবস্থাতেই যে অনুমোদন যোগ্য নয়, দুই নেতা তা পুনরায় নিশ্চিত করেছেন। দক্ষিণ চীন সাগরেও সে রকম চেষ্টার বিরোধিতা করেন তাঁরা।

চীনের চাপ বৃদ্ধি করে চলা এলাকা তাইওয়ান প্রণালীতে শান্তি ও স্থিতিশীলতার ওপর পুনরায় গুরুত্বারোপ করেন দুই নেতা। তবে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে বাইডেন বলেছেন, তাইওয়ানকে রক্ষায় সামরিক দিক থেকে জড়িত হতে যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহী। এই মন্তব্য যুদ্ধে জড়িত হতে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহী হওয়ার ইঙ্গিত দেয় কি না, একজন সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের উত্তরে বাইডেন বলেন, সেই অঙ্গীকার ইতিমধ্যে ব্যক্ত করা হয়েছে।

বাইডেনের এমন মন্তব্যে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে চীন। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, তাইওয়ান প্রসঙ্গটি সম্পূর্ণভাবেই চীনের নিজস্ব একটি বিষয়। বাইরের কোনো শক্তি এতে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তিনি আরও বলেন, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা স্বার্থ রক্ষায় দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে চীন।

মার্কিন প্রেসিডেন্টের গাড়ি বহর দেখতে টোকিওর সড়কে উৎসুক জাপানিরা
ছবি: রয়টার্স

তাইওয়ান প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র এতদিন পর্যন্ত অস্বচ্ছ একটি অবস্থান গ্রহণ করে তাইওয়ানে যুদ্ধাবস্থা দেখা দিলে দেশটির করণীয় সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত ছিল। জাপান সফরে এসে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ওয়াশিংটনের আগের সেই অবস্থান থেকে সরে যাওয়ার যে ইঙ্গিত দিলেন, আঞ্চলিক পরিস্থিতিকে তা হয়তো আরও ঘোলাটে করে তুলতে পারে।

আগামীকাল যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে গঠিত কোয়াড জোটের শীর্ষ বৈঠকে যোগ দেবেন বাইডেন। এই বৈঠকে যোগ দিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইতিমধ্যে টোকিও পৌঁছেছেন।