রাজাপক্ষেদের ওপর এত ক্ষোভ কেন
শ্রীলঙ্কার ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট দেশটিতে নজিরবিহীন বিক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। রাজপথে নেমেছেন হাজারো মানুষ। দেশটির এই দুর্দশার দায় শাসক রাজাপক্ষে পরিবারের ওপরই চাপাতে চাইছেন বিক্ষোভকারীরা। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণে বিক্ষোভে ফুঁসছেন জনগণ। খাদ্যপণ্য, ওষুধ ও জ্বালানির অভাব দেশজুড়ে। বিক্ষোভের মুখে সোমবার পদত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে। তারপরও বিক্ষোভ-সহিংসতা থামেনি। বিভিন্ন কারণে রাজাপক্ষে পরিবারের ওপর ক্ষোভ আরও বাড়ছে। খবর এএফপির।
রাজাপক্ষে পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরা
প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে (৭২) ‘টার্মিনেটর’ বলে পরিচিত। তিনি সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান। তামিল গেরিলাদের পরাস্ত করতে ভূমিকা রাখায় তিনি ‘টার্মিনেটর’ উপাধি পান নিজের পরিবার থেকে।
বর্তমান পরিস্থিতির জন্য এখন রাজাপক্ষ ব্র্যান্ডকে অনেকটাই দায়ী করা যেতে পারে। তবে তাদের উত্তরসূরিদেরও এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে। এতে রাজাপক্ষে ব্র্যান্ডের জন্য রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক থাকার জায়গা থাকছে।
তবে গোতাবায়ার বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষের লোকজনকে গুম করার জন্য ‘ডেথ স্কোয়াড’ গড়ার অভিযোগ রয়েছে। যদিও এ অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি। খুব দ্রুত মেজাজ হারান বলে প্রতিপক্ষও গোতাবায়াকে ভয় পায়।
শ্রীলঙ্কার ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকটের কেন্দ্রে রয়েছেন গোতাবায়া। বিশ্লেষকেরা বলছেন, করোনা মহামারির সময় নির্বাহী ক্ষমতার মাধ্যমে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায় দেশটির বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলেছেন গোতাবায়া।
২০১৯ সালে গোতাবায়া যখন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন, তখন তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে একটি বিপর্যস্ত অর্থনীতি পেয়েছিলেন। সন্ত্রাসী হামলা ও রাজনৈতিক সংকট দেশটির ওপর মারাত্মক আঘাত করে। নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর দ্রুতই কাজে নেমে পড়েন গোতাবায়া। তাঁর সরকার বিভিন্ন খাতে কর ছাড় দেওয়ার পাশাপাশি বাজারে নগদ অর্থ ছাড়তে শুরু করে। এতে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায়। কমে যায় কর আদায়। বাজেট ঘাটতি আরও বেড়ে যায়।
অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, রাজাপক্ষে পরিবারের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার জন্য বছরের পর বছর ধরে থাকা দীর্ঘস্থায়ী বাজেট ঘাটতি এবং নির্বিচার আয়করে কাটছাঁটও বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী।
পরিবার এখন শুধু একটা খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে
রাজাপক্ষে পরিবারের প্রধান ক্যারিশমাটিক নেতা হিসেবে মনে করা হয় মাহিন্দা রাজাপক্ষেকে (৭৬)। এর আগে ২০০৪ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ২০০৫ ও ২০১৫ সাল পর্যন্ত টানা ১০ বছর তিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিন বছর আগে ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া তাঁকে আবার দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন।
২০০৯ সালে বিচ্ছিন্নতাবাদী তামিল বিদ্রোহীদের দমনে নৃশংস সামরিক পন্থা গ্রহণ করেছিলেন মাহিন্দা।
এর মাধ্যমে এক দশকের দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটলেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের একাধিক অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, গৃহযুদ্ধের শেষ দিকে কথিত ‘গুলিবর্ষণ নিষিদ্ধ এলাকায়’ শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর বোমাবর্ষণে প্রায় ৪০ হাজার বেসামরিক নাগরিক নিহত হন। সেই সময় ক্ষমতায় থাকা মাহিন্দা রাজাপক্ষে এই নিহতের সংখ্যা অস্বীকার করেন এবং নৃশংসতার ওই অভিযোগ আন্তর্জাতিকভাবে তদন্ত করার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেন তিনি।
মাহিন্দার শাসনামলে শ্রীলঙ্কা আরও বেশি চীন-ঘনিষ্ঠ হয়েছে। চীনের কাছ থেকে অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য ৭০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি ঋণ নিয়েছে দেশটি। এর অধিকাংশ দুর্নীতির কারণে অকার্যকর সম্পদে রূপান্তরিত হয়েছে।
সমালোচকেরা বলেন, গৃহযুদ্ধ শেষ হলেও মাহিন্দা শ্রীলঙ্কার তামিলদের সঙ্গে বিভেদ দূর করতে তেমন কিছু করেননি। গৃহযুদ্ধে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণ করতেও তামিল বিদ্রোহী সম্প্রদায়ের বাধা দেওয়া হয়েছে এবং তাদের কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে।
মাহিন্দা রাজাপক্ষের অধীনে অর্থনীতি সামলানো ও রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে কাজ করা বাসিল রাজাপক্ষে (৭০) অর্থমন্ত্রী হিসেবে কাজ করেছেন।
বিবিসির এক সাক্ষাৎকারে তাঁকে ‘মিস্টার টেন পারসেন্ট’ বলা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সরকারি চুক্তি থেকে ১০ শতাংশ কমিশন নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। গোতাবায়া প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর বাসিলের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে গত এপ্রিলে বাসিলকে অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
মাহিন্দা যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন পার্লামেন্টের স্পিকার ছিলেন চামাল রাজাপক্ষে (৭৯)। বর্তমান সরকারের প্রতিরক্ষা বিভাগের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারীও তিনি। তাঁর ছেলে শশীন্দ্রর বিরুদ্ধে সার কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। ফলে তাঁকেও মানুষ খারাপের চোখে দেখেন।
রাজাপক্ষে পরিবারের ভবিষ্যৎ হিসেবে যাঁকে দেখা হচ্ছে, তিনি হলেন নামাল রাজাপক্ষে (৩৫)। আইনজীবী হিসেবে কাজ করা নামাল মাহিন্দা রাজাপক্ষের বড় ছেলে। ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট হিসেবে নামালকে নিজের মতো করে গড়ে তুলছেন মাহিন্দা। তাঁর বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচার ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। তবে নামাল এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন।
রাজাপক্ষে ব্র্যান্ড
রাজপক্ষে পরিবারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও অভিযোগ প্রসঙ্গে নামাল বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, তাঁর পরিবার এখন শুধু একটা খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে গবেষণা সংস্থা এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তা অখিল বেরি বলেছেন, মাহিন্দার পদত্যাগ সম্ভবত সক্রিয় রাজনীতিতে তাঁর সময় শেষ হওয়ার ইঙ্গিত দেয়। তবে সিংহলি জনগণের মধ্যে এখনো ‘রাজপক্ষে ব্র্যান্ডের’ প্রতি সমর্থন রয়েছে। তিনি আরও বলেন, যদিও বর্তমান পরিস্থিতির জন্য এখন রাজাপক্ষ ব্র্যান্ডকে অনেকটাই দায়ী করা যেতে পারে। তবে তাদের উত্তরসূরিদেরও এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে। এতে রাজাপক্ষে ব্র্যান্ডের জন্য রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক থাকার জায়গা থাকছে।