যতখানি ডুবেছে শ্রীলঙ্কা

কলম্বোর একটি পেট্রলপাম্পে দায়িত্বরত সেনাসদস্যরাছবি: রয়টার্স

শ্রীলঙ্কায় চলছে জ্বালানি তেলের ভয়াবহ সংকট। তেলের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে অসুস্থ হয়ে মারা যাচ্ছে মানুষ। বাড়ছে শিশুখাদ্যের দাম। কাগজের অভাবে পরীক্ষা দিতে পারছে না স্কুলশিক্ষার্থীরা। ঋণে জর্জরিত অর্থনীতি। জ্বালানি তেলের সংকটে সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ ঠেকাতে মাঠে নামানো হয়েছে সেনাবাহিনী। এরই মধ্যে দেশটির পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দিচ্ছে চীন। কিন্তু তাতেও কি ঘুরে দাঁড়াবে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি? কী কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপ দেশটিতে এ পরিস্থিতি তৈরি হলো? ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে তা।

শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০১৯ সালে গোতাবায়ে যখন দায়িত্ব নিলেন, তখন তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে একটি বিপর্যস্ত অর্থনীতি পেয়েছিলেন। সন্ত্রাসী হামলা এবং রাজনৈতিক সংকট দেশটির ওপর মারাত্মকভাবে আঘাত হয়ে এসেছিল। ২০০১ সালের পর থেকে দেশটির প্রবৃদ্ধি সর্বনিম্ন ছিল। এরপর আবার মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। করোনা মহামারির আঘাত। দেশটির আয়ের অন্যতম উৎস পর্যটন খাতে বড় ধরনের ধাক্কা লাগে। প্রায় এক দশক ধরে দেশটির পর্যটন থেকে আয় বেড়েছে। কিন্তু করোনা মহামারিতে তা শতকরা ২০ ভাগে নেমে আসে।

নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর দ্রুতই কাজে নেমে পড়েন গোতাবায়ে। তাঁর সরকার বিভিন্ন খাতে কর ছাড় দেওয়ার পাশাপাশি বাজারে নগদ অর্থ ছাড়তে শুরু করে। এতে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায়। কমে যায় কর আদায়। বাজেট ঘাটতি আরও বেড়ে যায়।

গোতাবায়ের ক্ষেত্রে একটি বড় সুবিধা হলো তাঁর ভাই প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী (মাহিন্দা, বাছিল) একই পরিবারের। তাঁদের আরেক ভাই চামালও মন্ত্রিসভার সদস্য। এই ভাইদের দুই ছেলেও (নামাল ও শশীন্দ্র রাজাপক্ষে) মন্ত্রিসভায় আছেন। শ্রীলঙ্কার মতো এক পরিবারের শাসনের নজির এ অঞ্চলের ইতিহাসে বেশ বিরল।

শ্রীলঙ্কায় বড় একটি সমস্যা সন্ত্রাসবাদ। এর চেয়েও বড় ধাক্কা দিয়েছে কোভিড। দেশটির রিজার্ভ মাত্র কয়েক মিলিয়ন ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার প্রাপ্তি কমে যাওয়ায় আমদানি বিল বেড়েই চলেছে। এর পেছনে কারণ অবশ্যই বিশ্বব্যাপী পণ্যের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি। ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদন বলছে, সম্প্রতি ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবও পড়েছে শ্রীলঙ্কার ওপরে। এ পরিস্থিতিতে রাজাপক্ষে অবশ্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেন। ২০২০ সালে মোটরগাড়ি আমদানি নিষিদ্ধ করেছিলেন। গত বছর তিনি রাসায়নিক সার আমদানি নিষিদ্ধ করেছিলেন। তার ফল হয়েছে উল্টো।

ইতিমধ্যে মুদ্রাস্ফীতি চরমে পৌঁছেছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের জনপ্রিয়তা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। বৈদেশিক রিজার্ভ খরচ না করে ডলারের বিপরীতে রুপির অবমূল্যায়ন করেছে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক। রুপির বিপরীতে ক্রমাগত ডলারের দাম বাড়ায় পণ্য আমদানি কমে গেছে। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে জ্বালানি তেল ও গ্যাস–সংকট। দেশটির বিদ্যুৎ উৎপাদনের বেশির ভাগই গ্যাস ও তেলনির্ভর। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী তেল-গ্যাস না পাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে। ফলে গত মাস থেকে লোডশেডিংয়ে ভুগছে দেশটির মানুষ। পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় ফেব্রুয়ারি মাস থেকে প্রতিদিন সাড়ে সাত ঘণ্টা লোডশেডিং দেওয়া শুরু করে বিদ্যুৎ বিভাগ। বিদ্যুতের ঘাটতি, গ্যাস–সংকট ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে ছোটখাটো ব্যবসায়।

পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি ঠেকানোর কৌশল বেছে নেয় শ্রীলঙ্কা। এরই অংশ হিসেবে ৭ মার্চ ডলারের বিপরীতে রুপির দর নির্ধারণ করে দেয় দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অন্তত পাঁচ মাসের জন্য প্রতি ডলারের বিপরীতে শ্রীলঙ্কান রুপির দাম নির্ধারণ করে ২০০ রুপিতে। কিন্তু কয়েক দিন পর আবারও রুপির মান ১৫ শতাংশ অবনমন করা হয়। বর্তমানে ডলার প্রতি রুপির দাম ২৬৫–তে গিয়ে ঠেকেছে।

আমদানি কমে যাওয়ায় খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে
ছবি: রয়টার্স

ডলারের বিপরীতে রুপির অব্যাহত দরপতন ঠেকাতে আমদানি খরচ বাড়ানো হলে এর প্রভাব পড়বে সাধারণ শ্রীলঙ্কানদের ওপর। গত ফেব্রুয়ারিতে পণ্যের দাম ১৫ শতাংশের বেশি বেড়েছে, যা বিগত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। অপরদিকে খাদ্যদ্রব্যের দাম ২৫ শতাংশ বেড়েছে।

মসুর ডাল, গুঁড়া দুধ, চিনি, ময়দাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়েই চলেছে। জ্বালানি তেলের সংকটের কারণে বিমান, রেল, বাস এমনকি অটোরিকশার ভাড়াও বেড়ে গেছে। অপর দিকে ভর্তুকি দেওয়া পণ্যের দামও বেড়েছে। এর মধ্যে প্যারাসিটামলের দাম বেড়েছে ২৯ শতাংশ। জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে উদ্বেগজনকভাবে। এ অবস্থায় ১২ মার্চ রাষ্ট্রীয় তেল-গ্যাস কোম্পানি পেট্রলের দাম ৪৩ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়িয়েছে, আর ডিজেলের দাম বাড়িয়েছে ৪৫ দশমিক ৫ শতাংশ।

পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে গেছে যে সাধারণ মানুষ এখন যাঁরা এ দলকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনেছেন, তাঁদেরই দায়ী করছে। জ্ঞান প্রসাদ নামের একজন গাড়িচালক বলেন, ‘আমি সরকারকে এ জন্য দায়ী করছি না। যাঁরা এই সরকারকে ভোট দিয়েছেন, দোষটা আসলে তাঁদের।’

আরও পড়ুন

ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও জ্বালানি তেল না পেয়ে প্রতিবাদে রাস্তায় নামছে মানুষ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ও জ্বালানি তেল বিতরণ পর্যবেক্ষণে গত মঙ্গলবার সেনা মোতায়েন করেছে শ্রীলঙ্কা সরকার।

সরকারের মুখপাত্র রমেশ পাথিরানা বলেছেন, কেরোসিন তেল কিনতে না পারায় বিক্ষুব্ধ লোকজন কলম্বোয় গুরুত্বপূর্ণ একটি সড়ক অবরোধ করে। এতে কয়েক ঘণ্টা সেখানে যান চলাচল বন্ধ থাকে। এরপর সেনা মোতায়েন করা হয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, স্টোভে রান্নার জন্য কেরোসিন না পেয়ে একদল উত্তেজিত নারী পর্যটকবাহী বাস আটকে দেন। পাথিরানা বলেন, ‘আমরা দেখেছি পর্যটকদের আটকে রাখা হয়েছে। আমাদের কাছে খবর আছে, কিছু ব্যক্তি তেল মজুত করছে। সে কারণে সরকার সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’

শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির একটি উৎস পর্যটন। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধানতম এ খাত থেকে বলার মতো আয় হয়নি। প্রবাসী নাগরিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সও কমে গেছে। পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছে। ফেব্রুয়ারি শেষে শ্রীলঙ্কান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ মাত্র ৭৩৪ মিলিয়ন ডলারে ঠেকেছে। কিন্তু চলতি বছরেই দেশটিকে ৬ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের ঋণ ও সুদ পরিশোধ করা লাগবে। দেশটির বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ এতটাই বেড়ে গেছে যে মোটা অঙ্কের ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না।

এমন পরিস্থিতিতে দেশটিতে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে। গ্রামে ফিরতে বাসের টিকিটের দাম কমানোর দাবিতে বড় বড় শহরে মোমবাতি প্রজ্বালন করছে সাধারণ মানুষ। সমাজকর্মী শাহান ভিরানাতুঙ্গা বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আমাদের দেশের প্রবৃদ্ধি কীভাবে ঋণাত্মক হলো বুঝলাম না।’ তিনি বলেন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি এর বড় কারণ।

আরও পড়ুন
ডিজেল–গ্যাসের সংকটের কারণে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে কেরোসিন তেলের জন্য মানুষের অপেক্ষা
ছবি: রয়টার্স

১৫ মার্চ রাজধানী কলম্বোতে হাজার হাজার মানুষ সরকারবিরোধী সমাবেশ করে। শুধু রাজপথেই নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও পরিস্থিতি নিয়ে সরব সাধারণ মানুষ। দেশটির প্রধান তিনটি ভাষায় সামাজিক মাধ্যমে মানুষ এ পরিণতির জন্য রাজাপক্ষে ও তাঁর সরকারকে দায়ী করছে।

চলমান পরিস্থিতিতে টিকতে না পেরে অনেক শ্রীলঙ্কান অন্য দেশে কাজে যেতে চাইছেন। নতুন পাসপোর্ট পেতে দেশটির অভিবাসন বিভাগের সামনে মানুষের ভিড় বাড়ছে। এ সময় দেখা হয় পেরেরার (৫৭) সঙ্গে। স্ত্রীর নতুন পাসপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছেন সেখানে। একজনের উপার্জনে টিকে থাকা দায় হয়ে পড়ায় তাঁর স্ত্রী সৌদি আরবে গৃহকর্মীর কাজ করতে যাচ্ছেন।