মুখোমুখি যুক্তরাষ্ট্র-ইরান: ইতিহাস কী বলে
একেবারেই মুখোমুখি অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানে হামলার অনুমোদন দেওয়ার পরও হামলা চালানোর মাত্র ১০ মিনিট আগে তা স্থগিত করেন। এর আগে আকাশসীমা লঙ্ঘনের অভিযোগে মার্কিন ড্রোন গুলি করে ভূপাতিত করে ইরান। যদিও ওয়াশিংটন বলছে, তার ড্রোন আন্তর্জাতিক আকাশসীমার মধ্যেই ছিল।
এরপর থেকেই চলছে দুই পক্ষের বাগ্যুদ্ধ। ট্রাম্প বলছেন, ‘ড্রোন ভূপাতিত করে ইরান বড় ভুল করেছে।’ পাল্টা ইরানের জেনারেল বলছেন, ‘ইরানে গোলা পড়লে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থসংশ্লিষ্ট স্থাপনায় আগুন জ্বলবে।’ এই বাদানুবাদের মধ্যে ইরানের সমরাস্ত্র-ব্যবস্থায় সাইবার হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। এরপর কী হবে—সময় হলেই তা জানা যাবে। তবে এই দুই দেশের সম্পর্কের অতীতটা কেমন? চলুন দেখে নেওয়া যাক—
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইরানের বিশাল তেলসম্পদের ওপর নজর পরে তৎকালীন পরাশক্তিগুলোর। সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন ব্লক ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ব্লক মরিয়া হয়ে ওঠে সেই তেলের জন্য। দুই ব্লকের গোয়েন্দারা তৎপর হয়। এরই মধ্যে ক্ষমতায় আসেন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ইরানের জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেক। ধর্মনিরপেক্ষ বলে পরিচিত মোসাদ্দেক দেশটির তেলশিল্প জাতীয়করণ করার পক্ষে ছিলেন। এটা পছন্দ হয়নি যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের। পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে ১৯৫৩ সালে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সফল হয় সিআইএ-এমআই৬। এর মাধ্যমে ইরানে ক্ষমতা পাকাপোক্ত হয় মার্কিনপন্থী বলে পরিচিত মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভীর। যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের কোম্পানিগুলো ইরানের তেলশিল্পে ঢোকার অবাধ সুযোগ পায়। প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করার অভ্যুত্থানে কলকাঠি নাড়ার কথা ২০০০ সালে স্বীকার করেন তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেডেলিন অলব্রাইট।
ইঙ্গ-মার্কিন বন্ধু পাহলভি
পাহলভির সঙ্গে সম্পর্কটা ভালোই যাচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, এর ধারাবাহিকতায় ১৯৫৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান বেসামরিক পারমাণবিক সহযোগিতা চুক্তি সই করে। ১৯৬৮ সালে ইরান পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতেও (এনপিটি) স্বাক্ষর করে। এর দুই বছর পর থেকে দেশটি বেসামরিক কাজে ব্যবহারের জন্য পারমাণবিক কর্মসূচি চালানোর অনুমতি পায়। পাহলভি ইরানে ‘সাদা বিপ্লবের’ সূচনা করেছিলেন। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সংস্কার এবং দেশকে পাশ্চাত্য ধারার আধুনিকায়নের পথে এগিয়ে নিতে থাকেন। এ কারণে দেশটির প্রভাবশালী শিয়া নেতাদের সমর্থন হারান তিনি। দেশটির কর্মজীবীশ্রেণিও তাঁর প্রতি নাখোশ হয়। এ সময়টায় রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের কঠোর হাতে দমন করেন পাহলভি। ইরানের সরকারি হিসাবে দেখা যায়, ১৯৭৮ সালে দেশটির কারাগারগুলোয় ২২০০ রাজনৈতিক বন্দী ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের মদদে ইসলামপন্থী ও সেক্যুলার—দুই পক্ষের ওর নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছিলেন পাহলভি। একপর্যায়ে পাহলভির বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। ইসলামপন্থী ও সেক্যুলার পক্ষের কয়েক মাসের টানা আন্দোলনে ১৯৭৯ সালের জানুয়ারিতে পতন ঘটে পাহলভির। শুধু পতনই নয়, ১৬ জানুয়ারি ইরান ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন তিনি।
পাহলভির ইরান ছেড়ে পালানোর দুই সপ্তাহ পর নির্বাসন থেকে দেশে ইরানে ফেরেন আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি। এরপর এক গণভোটে ১৯৭৯ সালের ১ এপ্রিল ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ইরান। দেশটির সর্বোচ্চ নেতার পদে আসীন হন আয়াতুল্লাহ খোমেনি। ওই বছরের ৪ নভেম্বর তেহরানে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসে ঢুকে কর্মীদের জিম্মি করা হয়। জিম্মিকারীরা পাহলভিকে ইরানের হাতে তুলে দিতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দাবি জানাতে থাকে।
তিক্ততার ইতিহাস
এরপর ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক মূলত তিক্ততার ইতিহাস। মার্কিন দূতাবাসে এই জিম্মিদশা চলে ৪৪৪ দিন। এই পরিস্থিতিতে ১৯৮০ সালে ইরানের সঙ্গে সব ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে থাকা ইরানের সব সম্পদ জব্দ করে ও সব ধরনের বাণিজ্য নিষিদ্ধ করে। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের নির্দেশেও জিম্মি উদ্ধার অভিযান ব্যর্থ হয়। মার্কিন হেলিকপ্টার ধূলিঝড়ে বিধ্বস্ত হয়ে আটজন মার্কিন নিহত হন। ১৯৮১ সালের ২০ জানুয়ারি জিমি কার্টার পদত্যাগ করার কয়েক মিনিটের মধ্যেই দূতাবাস থেকে ৫২ জন জিম্মিকে মুক্তি দেয় ইরান।
১৯৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্রের তালিকায় যুক্ত করে। এর মধ্যেই ইরানের সঙ্গে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের গোপন যোগসাজশের খবর প্রকাশ হয়। ইরানের কাছে অস্ত্র বিক্রিতে কংগ্রেসের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে রিগ্যান প্রশাসন গোপনে অস্ত্র বিক্রি করে। সেই অস্ত্র বিক্রির অর্থ নিকারাগুয়ায় কমিউনিস্টবিরোধী কন্ট্রাবিদ্রোহীদের কাছে পাঠানো হয়। রিগ্যান প্রশাসন বলে, লেবাননে কট্টরপন্থী সংগঠন হিজবুল্লাহর হাতে জিম্মি সাত আমেরিকানকে মুক্ত করতে তেহরানের সহযোগিতার আশ্বাস পেয়ে তাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করা হয়। এই খবর প্রকাশে ওই সময় বিপাকে পড়েন প্রেসিডেন্ট রিগ্যান।
যুক্তরাষ্ট্র ১৯৮৮ সালে ভয়ংকর ঘটনা ঘটায়। ইরানের একটি যাত্রীবাহী উড়োজাহাজে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় তারা। এতে উড়োজাহাজের ২৯০ আরোহীর সবাই নিহত হন। পরে ওয়াশিংটন দাবি করে, ভুল করে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে। এয়ারবাস এ-৩০০ মডেলের উড়োজাহাজটিকে যুদ্ধবিমান ভেবে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে মার্কিনবাহিনী। ওই উড়োজাহাজটি ইরান থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত যাচ্ছিল।
আমেরিকা ২০০০ সালের দিকে অভিযোগ তোলে, ইরান গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ২০০২ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জজ ডাব্লিউ বুশ ইরান, ইরাক ও উত্তর কোরিয়াকে ‘শয়তানের অক্ষ’ বলে আখ্যা দেন। ওই বছরই বুশ প্রশাসন আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ তোলে, ইরান গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ইরানের সরকারবিরোধী নির্বাসিত একটি পক্ষ দাবি করে, ইরান দুটি পারমাণবিক স্থাপনা নির্মাণ করেছে। এর একটি নাতাৎজ এলাকায়—যেখানে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্ল্যান্ট রয়েছে। অন্য স্থাপনাটি আর্ক এলাকায়; এখানে ভারী পানি উৎপাদনে পারমাণবিক চুল্লি বসানো হয়েছে।
বরফ গলার শুরু
যুক্তরাষ্ট্র-ইরানের সাপে-নেউলে সম্পর্কে নতুন দিগন্ত দেখা দেয় ২০০৬ সালে। যাকে বলা যায় কাছে আসার গল্প! ওই বছর ওয়াশিংটন ঘোষণা দেয়, ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি থেকে সরে এলে তেহরানের সঙ্গে বহুজাতিক আলোচনায় অংশ নিতে আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র। এরপর ২০০৭ সালে মে মাসে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিৎসা রাইস ও ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মানুচের মোত্তাকি মিসরে এক সম্মেলনে যোগ দেওয়ার পাশাপাশি পরস্পরের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেন। ওই বছরের ডিসেম্বরে মার্কিন গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়, ২০০৩ সাল পর্যন্ত ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কার্যক্রম এগিয়ে নিয়েছে। পরে তা স্থগিত করেছে। ২০০৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ প্রথমবারের মতো সরাসরি আলোচনায় বসতে ইরানের প্রতি আনুষ্ঠানিক বার্তা পাঠান।
সেই ধারাবাহিকতায় পরের বছর মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেন, ইরানের সঙ্গে আলোচনার হাত বাড়ানো থাকবে, যদি তেহরান পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করে। ওবামা প্রশাসন তেহরানকে এই কর্মসূচি থেকে সরে আসতে প্রভাবিত করতে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতিও আহ্বান জানান। ২০১২ সালে ইরানের সঙ্গে গোপনে আলোচনা শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৩ সালে সেই আলোচনা আরও জোরালো হয়। দুই পক্ষের আলোচনার কেন্দ্রে থাকে ইরানের পারমাণবিক ইস্যু। ওই বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন বারাক ওবামা। বিগত তিন দশকের মধ্যে দুই দেশের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে এটা সরাসরি কথা বলার ঘটনা এটাই প্রথম। ২৩ নভেম্বর ইরানের সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তিতে পৌঁছায় ছয় বিশ্বশক্তি (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি ও জাতিসংঘ)। চুক্তি অনুযায়ী ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে সরে আসবে। বিনিময়ে ইরানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৫ সালে ইরান ছয় বিশ্বশক্তির সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী চুক্তিতে পৌঁছায়। ২০১৬ সালে তেহরানের ওপর থেকে কিছু নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে ওয়াশিংটন।
সব ভেস্তে দিলেন ট্রাম্প
মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় এসে সব ওলট-পালট করে দেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি নির্বাচনী প্রচারণাতে বলেছিলেন, ক্ষমতায় গেলে ইরানের সঙ্গে করা চুক্তি থেকে সরে আসবেন। তাই করলেন। গত বছরের মে মাসে ট্রাম্প ওই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন। ইরানের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেন—৪ নভেম্বর থেকে সেই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইরানের কাছ থেকে তেল আমদানি করা দেশগুলোর ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ওয়াশিংটন। এদিকে এর প্রতিক্রিয়া ইরানও নতুন করে নিজেদের পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করার ঘোষণা দেয়। তবে সঙ্গে এ ঘোষণাও দেয়, পশ্চিমা দেশগুলো ওয়াশিংটনকে তেহরানের ওপর অবরোধ আরোপ থেকে বিরত রাখলে, তেহরান বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবে।
ফের মুখোমুখি
ট্রাম্প ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর উপসাগরীয় অঞ্চলে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। রণতরি পাঠানোর পাশাপাশি যুদ্ধবিমানও মোতায়েন করে ওয়াশিংটন। এর মধ্যে গত মে ও জুন মাসে উপসাগরীয় অঞ্চলে ছয়টি তেলবাহী ট্যাংকারে হামলার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনার জন্য ইরানকে দায়ী করে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও তেহরান সব সময় এই অভিযোগ নাকচ করে আসছে। এ বিষয় নিয়ে কথার লড়াই চলতে থাকে দুই পক্ষের মধ্যে। এমন পরিস্থিতিতে ২০ জুন ইরান জানায়, আকাশসীমা লঙ্ঘন করায় তারা গুলি করে মার্কিন ড্রোন ভূপাতিত করেছে। পরে বিষয়টি স্বীকারও করে যুক্তরাষ্ট্র। সঙ্গে অভিযোগ করে, এর আগের সপ্তাহেও ইরান মার্কিন একটি ড্রোনকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছিল।
মার্কিন ড্রোন ভূপাতিত হওয়ার পর ক্ষুব্ধ ট্রাম্প ইরানের বিরুদ্ধে পাল্টা সামরিক হামলার অনুমোদন দিয়েছিলেন। হোয়াইট হাউসের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে যা ২১ জুন প্রকাশ করে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস। হামলার যখন সব প্রস্তুতি সম্পন্ন, ১০ মিনিট পরেই হামলা চালানো হবে—এমন সময় সেই হামলা থামানোর নির্দেশ দেন ট্রাম্প। ওই খবর প্রকাশের পর ট্রাম্প নিজেই টুইট করে বলেন, ‘প্রতিশোধ নেওয়ার দিকেই আমরা ঝুঁকেছিলাম। হামলার ১০ মিনিট আগে আমি তা থামাই। ড্রোন ভূপাতিত করার সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই। হামলার জন্য আমার তাড়া নেই।’