মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের এক বছর: ‘এ যেন অন্ধকার যুগে বসবাস’
২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। মিয়ানমারের নতুন পার্লামেন্টে অধিবেশনের প্রস্তুতি চলছিল। আর তার আগেই ভোরবেলা অভিযান চালিয়ে ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) নেত্রী অং সান সু চিসহ আইনপ্রণেতাদের আটক করেন সেনাসদস্যরা। অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার ইতি টানা হয়। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী সংঘাত, অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভ। মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হতে চলেছে। দিনটিকে সামনে রেখে এক প্রতিবেদনে মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরেছে বার্তা সংস্থা এএফপি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এক বছর পরও ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে মিয়ানমারের জান্তা। প্রতিদিনই ঘটছে সংঘর্ষের ঘটনা।
জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ ও চলমান ধরপাকড় অভিযানে প্রায় দেড় হাজার বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করা হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছে ১১ হাজারের বেশি। স্থানীয় এক পর্যবেক্ষকের তথ্য অনুযায়ী, মানবাধিকার সংগঠনগুলো জান্তা সেনাদের বিরুদ্ধে নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটনের অভিযোগ এনেছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, সংকটের কারণে মিয়ানমারের অর্থনীতি বিধ্বস্ত হচ্ছে, স্কুল ও হাসপাতাল ফাঁকা হয়ে পড়ছে, অনেকে প্রতিবেশী দেশে পালিয়ে যাচ্ছে। আর এ সংকটের শিগগিরই শেষ হওয়ার আলামতও দেখা যাচ্ছে না।
ইয়াঙ্গুনের একটি বাজারে দাঁড়িয়ে হটু অং (ছদ্মনাম) নামে একজন এএফপিকে বলেন, ‘আমরা এখন এক অন্ধকার যুগে বাস করছি। নিজেদের জীবনের লক্ষ্য, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন নিয়ে ভাবার সুযোগ নেই। বরং সামরিক স্বৈরশাসকের অধীনে দৈনন্দিন জীবনযাপনের জন্য কীভাবে সংগ্রাম করতে হবে, তা নিয়ে ভাবতে হয় আমাদের।’
জান্তা সরকার আভাস দিয়েছে, ইয়াঙ্গুন ও অন্য শহরগুলোতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। রাস্তাঘাটে আবারও যানজট দেখা দেওয়া এবং মার্কেটে ধীরে ধীরে মানুষের ভিড় বাড়তে থাকবে।
তবে এএফপি বলছে, আগামী ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির আগে তেমনটা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সম্প্রতি কর্তৃপক্ষ হুঁশিয়ার করে বলেছে, যারা রাস্তায় গাড়ির হর্ন দিচ্ছে ও হাঁড়ি-পাতিল বাজাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হতে পারে। উল্লেখ্য, মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর গাড়ির হর্ন ও হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে বাজানোর মধ্য দিয়ে প্রতিবাদের ধরনটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
তবে নিষেধাজ্ঞার পরও সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে দৈনিক সংঘাতের মাত্রা কমার কোনো আলামত দেখা যায়নি। বিভিন্ন জায়গায় সেনাসদস্যদের বিরুদ্ধে গেরিলা ও স্থল মাইন হামলা চালানো হচ্ছে। জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা ছায়া সরকারের আইনপ্রণেতারা দাবি করেছেন, গত বছরের জুন থেকে নভেম্বরে ছায়া সরকারের সামরিক শাখা পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সের (পিডিএফ) সঙ্গে সংঘর্ষে প্রায় তিন হাজার সেনাসদস্য নিহত হয়েছেন। অপর দিকে জান্তা সরকার বলছে, ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১৬৮ সেনা ও পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মিয়ানমারবিষয়ক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা রিচার্ড হোরসি বলেন, এক বছরের সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপরও প্রভাব পড়েছে। সেনাবাহিনী এখন মনোবল ও নিয়োগ–সংকটের মধ্যে আছে। তবে এসব চ্যালেঞ্জের কারণে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ক্ষমতা ছাড়বে বলে মনে করেন না হোরসি।
গত বছরের বড়দিনে (২৫ ডিসেম্বর) মিয়ানমারের পূর্বাঞ্চলের একটি সড়কে হামলা চালিয়ে ৩০ জনের বেশি মানুষকে হত্যার জন্য জান্তা সেনাদের দায়ী করা হয়ে থাকে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে সেভ দ্য চিলড্রেনের দুই কর্মীও রয়েছেন। জানুয়ারির শুরুর দিকে অভ্যুত্থানবিরোধী লড়াই ঠেকাতে পূর্বাঞ্চলীয় একটি এলাকায় বিমান হামলার নির্দেশ দেয় সেনাবাহিনী।
সু চির বিরুদ্ধে বিশেষ আদালতে রুদ্ধদ্বার বিচার প্রক্রিয়া চলমান। কয়েকটি মামলায় তাঁর কারাদণ্ডও হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে করা বিভিন্ন দুর্নীতির মামলায় সামনের মাসগুলোতে আরও সাজা হতে পারে। প্রতিটি মামলার সর্বোচ্চ শাস্তি ১৫ বছরের কারাদণ্ড।
মিয়ানমারের সেনা কর্মকর্তাদের জাতিসংঘ থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে চীন ও রাশিয়া। তা ছাড়া ইথিওপিয়া, ইয়েমেন ও ইউক্রেন সংকটের দিকে বিশ্বনেতাদের এখন মনোযোগ বেশি। এমন অবস্থায় মিয়ানমারের নাগরিকদের অনেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে সহযোগিতা পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছে।
হটু অং (ছদ্মনাম) বলেন, প্রায় প্রতিদিনই সেনাবাহিনী বিক্ষোভকারীদের হত্যা করছে, যা বিশ্ব টেরই পাচ্ছে না।
এদিকে সেনা জেনারেলরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তারা বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফেরত যাবেন এবং ২০২৩ সালে নতুন নির্বাচনের আয়োজন করবেন। তবে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা রিচার্ড হোরসি তা মানতে নারাজ। তিনি মনে করেন এমনটা হওয়ার সুযোগ নেই। হোরসি মনে করেন, সহিংস সংঘাতের যে প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে তা আরও কয়েক মাস, এমনকি কয়েক বছরও চলতে পারে।