মহাসাগরগুলো বড় সংকটে, সতর্কবার্তা জাতিসংঘের
আজ ২৩ মার্চ বিশ্ব আবহাওয়া দিবস সামনে রেখে ওয়ার্ল্ড মেটেরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশন (ডব্লিউএমও) মহাসাগরের সংকটাপন্ন হওয়ার বিষয়টিই সামনে এনেছে।
জলবায়ু পরিবর্তন বিরূপ প্রভাব ফেলছে মহাসাগরের ওপর। দ্রুত বদলাচ্ছে মহাসাগরের আবহাওয়া। সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতার সঙ্গে বাড়ছে স্রোতের উষ্ণতা। মহাসাগরের উপরিভাগের বাতাস হয়ে উঠছে ভয়ংকর। ফলে ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, হারিকেনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেশি হচ্ছে। বাড়ছে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি।
কোভিড–১৯ মহামারি এই বিপদ আরও বাড়িয়ে তুলেছে। মহাসাগরের আবহাওয়াগত পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা অনেকটাই থমকে গেছে। ফলে তথ্যপ্রাপ্তির উৎস হয়ে এসেছে সংকুচিত। সমস্যায় পড়তে হচ্ছে আগাম পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রেও।
এই পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনকার মতো হুমকির মুখে আগে কখনোই পড়তে হয়নি মহাসাগরকে। সংস্থাটির মতে, সময়মতো তৎপর না হলে গভীর সংকটে পড়বে মহাসাগর। তাতে বাধাগ্রস্ত হবে বাণিজ্য। সংকটে পড়বে মানবজাতি।
বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে আলোচনায় মহাসাগর অনেকটা উপেক্ষিত থাকলেও মঙ্গলবার বিশ্ব আবহাওয়া দিবস সামনে রেখে ওয়ার্ল্ড মেটেরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশন (ডব্লিউএমও) এবার মহাসাগরের সংকটাপন্ন হওয়ার বিষয়টিই সামনে এনেছে। এবার দিবসের প্রতিপাদ্যও ছিল ‘মহাসাগর, আমাদের জলবায়ু ও আবহাওয়া’।
ইউএন নিউজ জানিয়েছে, গত বছর আটলান্টিক মহাসাগরে রেকর্ডসংখ্যক হারিকেনের দেখা মিলেছে। প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণাংশ ও ভারত মহাসাগরে সাইক্লোন বেশি হয়েছে। এর প্রধান কারণ মহাসাগরের উষ্ণতা বেড়ে যাওয়া। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে উপকূলীয় অঞ্চল প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা নিয়ে যতটা আলোচনা হয়, উষ্ণতা বৃদ্ধিজনিত হুমকি অনেকটাই উপেক্ষিত থেকে যায়।
ডব্লিউএমওর মহাসচিব অধ্যাপক পেটেরি টালাস বলেন, ‘বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ উপকূলের ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে বাস করে। তাই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া, ভয়ংকর স্রোত কিংবা সাইক্লোনের কবল থেকে এসব মানুষ ও তাদের বসতি রক্ষা করা জরুরি।’
উষ্ণতার পরিবর্তন মহাসাগরের বাস্তুসংস্থানের ওপর যে প্রভাব ফেলবে, তার জন্য চড়া মূল্য দিতে হবে বলেও সতর্ক করেছেন পেটেরি টালাস। তাঁর ভাষ্য, এর জের শত শত বছর ধরে পৃথিবীকে টানতে হবে।
হুমকিতে ‘ব্লু ইকোনমি’
সমুদ্রকেন্দ্রিক অর্থনীতি বা ব্লু ইকোনমি বিশ্বের ৬০০ কোটির বেশি মানুষের জীবন–জীবিকার সঙ্গে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে জড়িত। বিশ্ববাণিজ্যে প্রতিবছর ৩ থেকে ৬ লাখ কোটি টাকা জোগান দেয় ব্লু ইকোনমি। তাই মহাসাগরের আচরণ পরিবর্তন বিপুল পরিমাণ মানুষের মহাসাগরকেন্দ্রিক জীবন–জীবিকায় আঘাত হানবে বলে সতর্ক করেছে ডব্লিউএমও।
‘বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ উপকূলের ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে বাস করে। তাই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া, ভয়ংকর স্রোত কিংবা সাইক্লোনের কবল থেকে এসব মানুষ ও তাদের বসতি রক্ষা করা জরুরি।’—পেটেরি টালাস, ডব্লিউএমওর মহাসচিব
প্রতিবছরই মিলিয়ন ডলারের পণ্য ও জীবন কেড়ে নেয় সাগর–মহাসাগর। এর পেছনে তীব্র বাতাস, উচ্চ স্রোত, কুয়াশা, বজ্রপাত, বরফখণ্ডসহ চরম আবহাওয়াকে দায়ী করেছে ডব্লিউএমও। মহাসাগর বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতার ৯০ শতাংশের বেশি শোষণ করে নেয়। এতে মহাসাগরের উষ্ণতা দ্রুত বেড়ে যায়। মহাসাগরের উষ্ণ স্রোত হাজার কিলোমিটার দূরের মানুষের জীবন–জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
বসে থাকার অবকাশ নেই
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মেরু অঞ্চলের বরফ দ্রুত গলতে শুরু করেছে। ডব্লিউএমও বলছে, মেরু অঞ্চলে বরফ কম থাকা মোটেও খুশির খবর নয়। ডব্লিউএমও প্রধান সতর্ক করে বলেন, মহাসাগরের এমন আবহাওয়াগত পরিবর্তন শত বছর ধরে ক্ষতির কারণ হতে পারে।
মেরু অঞ্চলসহ বিশ্বজুড়ে মহাসাগরের আবহাওয়া পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বসে থাকার সুযোগ নেই বলে মনে করছে ডব্লিউএমও। সংস্থাটির মতে, প্রতিটি দেশের আবহাওয়া কেন্দ্রগুলোকে শুধু ভূমিতে নয়, বরং মহাসাগরেও জীবন ও সম্পদ রক্ষায় সার্বক্ষণিক মনোযোগ দিতে হবে। এটা হবে ২৪ ঘণ্টার কাজ।
সমুদ্রকেন্দ্রিক অর্থনীতি বা ব্লু ইকোনমি বিশ্বের ৬০০ কোটির বেশি মানুষের জীবন-জীবিকার সঙ্গে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে জড়িত। বিশ্ববাণিজ্যে প্রতিবছর ৩ থেকে ৬ লাখ কোটি টাকা জোগান দেয় ব্লু ইকোনমি। তাই মহাসাগরের আচরণ পরিবর্তন বিপুল পরিমাণ মানুষের মহাসাগরকেন্দ্রিক জীবন-জীবিকায় আঘাত হানবে বলে সতর্ক করেছে ডব্লিউএমও।
সংকট বাড়িয়েছে করোনা
মহাসাগরের আবহাওয়া পরিস্থিতির সার্বক্ষণিক তদারকি জরুরি। তবে এ ক্ষেত্রে গবেষণালব্ধ তথ্যপ্রাপ্তিতে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। গত বছরের মার্চ নাগাদ বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারি চরম আকারে ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন দেশের সরকার ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো মহাসাগর ও মেরু অঞ্চলে অবস্থান করা গবেষণা জাহাজগুলোকে ফেরত আসার নির্দেশনা দেয়। এর ফলে এ ক্ষেত্রে হালনাগাদ তথ্যপ্রাপ্তিতে ঘাটতি তৈরি হয়েছে। তথ্যপ্রাপ্তির উৎস সংকুচিত হওয়ায় সমস্যায় পড়তে হচ্ছে আগাম পূর্বাভাস প্রদানের ক্ষেত্রে। ডব্লিউএমওর মতে, এই ঘাটতি দূর করা জরুরি।
ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলতে গিয়ে সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেছে ডব্লিউএমও। সংস্থাটি বলছে, যদি গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন কমে আসে ও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা সম্ভব হয়, এরপরও ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৩০–৬০ সেন্টিমিটার বাড়তে পারে। আর যদি গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমনে লাগাম টানা সম্ভব না হয়, তবে এর পরিমাণ ৬০–১১০ সেন্টিমিটার হতে পারে।