ভিনদেশি 'আদর্শ বধূ' এমার গল্প
জন্মস্থান ফিলিপাইন থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ কোরিয়ার পাহাড়ি এক গ্রামে বৃদ্ধ শাশুড়ির দেখাশোনা করেন এমা সুমাম্পং। পাশাপাশি স্বামী আর বাচ্চাদের যত্ন নেন। পারিবারিক খামারে কাজ করেন। একই সঙ্গে খণ্ডকালীন একটি চাকরিও করছেন। এভাবেই তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার ‘আদর্শ’ স্ত্রীর সম্মানে ভূষিত।
দূর দেশ থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার ছেলেদের বিয়ে করে দেশান্তরিত হওয়া হাজার হাজার নারীদের একজন এমা। দেশটিতে মানুষের গড় আয়ু খুব দ্রুত বেড়ে চলেছে। স্থানীয় নারীদের মধ্যেও বিয়ের প্রবণতা কমছে। তবে ঐতিহ্যগতভাবে স্থানীয় লোকজন প্রত্যাশা করেন, স্ত্রীরা শুধু স্বামী নয়, বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়িরও যত্ন নেবেন।
ফিলিপাইনের চার্চ ম্যাচমেকিং সার্ভিসের মাধ্যমে স্বামী লি বাইং-হোয়ের সঙ্গে দেখা হয় এমার। তাঁর মতো অভিবাসী নারীর কারণে দক্ষিণ কোরিয়ার স্থানীয় লোকজনের প্রত্যাশা কিছুটা পূরণ হচ্ছে।
হংকং ও সিঙ্গাপুরের মতো অর্থনীতির দিক থেকে এগিয়ে থাকা এশিয়ার অন্যান্য দেশের আদলে বিদেশি কর্মীদের সহায়তা করে না দক্ষিণ কোরিয়া। জাতিগতভাবে কোরীয় না হলে সুরক্ষা শিল্পে কাজ করার অনুমতি মেলে না। তবে গ্রামাঞ্চলের কিছু অংশে অবিবাহিত ছেলেদের জন্য তথাকথিত বিবাহ ভ্রমণ অনুদান দেওয়া হয়। স্থানীয় নারীদের মধ্যে থেকে স্ত্রী খুঁজে বের করতে এই সুবিধা দেওয়া হয় তাঁদের।
গ্রামের বাড়িতে তিন প্রজন্মের দেখভাল করতে হয় এমাকে। এরপরও তাঁকে অবশ্যই পারিবারিক জমিতে কাজ করতে হবে এবং চাকরি করতে হবে।
৪৮ বছর বয়সী এই নারী বলেন, ‘কোনো ধরনের অসুবিধা হলে তা কাটিয়ে ওঠার মানসিক এবং শারীরিক সামর্থ্য আমার থাকতে হবে।’
তার দিন শুরু হয় ভোর পাঁচটায়। ঘুম থেকে উঠে নাশতা বানিয়ে ঘরের কাজ শেষ করে তিন বাচ্চাকে স্কুলে নিয়ে যান। সেখান থেকে সোজা চলে যান কাউন্টি অফিসে। এখানেই কেরানি হিসেবে কাজ করছেন তিনি।
যেদিন দুপুরে অফিসে যেতে হয় না, এমা সেদিন পরিবারের জন্য রান্নাবান্না করেন। ঘরদোর পরিষ্কার করেন। বাচ্চাদের পড়ালেখায় সাহায্য করেন। এরপর খেতে গিয়ে শাকসবজির বাগানের যত্ন নেন।
৮৯ বছর বয়সী শাশুড়ির পরিচর্যার দায়িত্ব মূলত তাঁরই। তিনি একা হাঁটতে পারেন না। গোসল করতে বা পোশাক পরতে পারেন না।
এমার কাজগুলো খতিয়ে দেখা হয়েছে। চলতি বছরের জুন মাসে দেশটির পরিবারকল্যাণ সমিতি তাঁকে ‘হায়বু’ সম্মানে ভূষিত করে। বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ির যত্ন নেওয়ার জন্য তাঁকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। ২০১২ সালে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত অসুস্থ শ্বশুরকে দেখার দায়িত্বও ছিল তাঁর।
অভিবাসী স্ত্রীদের জন্য আলাদা শ্রেণি থাকলেও জাতীয় এই সম্মাননা সবার জন্য উন্মুক্ত। তবে দক্ষিণ কোরিয়ার নারীরা এ ধরনের দেখাশোনার পথ এড়িয়ে যাওয়ায় ঐতিহ্যবাহী ‘বধূ’ চরিত্রে স্থানীয় নারীদের খুঁজে পাওয়া ভার।
পিতৃতান্ত্রিক মনোভাবের ফলে ধরে নেওয়া হয় কর্মজীবী মায়েদের অবশ্যই চাকরির পাশাপাশি ঘরোয়া কাজও করতে হবে। এমন আরোপিত দায়িত্বের কারণে অনেক মেয়েই বিয়ের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
গত বছর এক জরিপে দেখা গেছে, দক্ষিণ কোরিয়ার মাত্র ২২.৪ শতাংশ অবিবাহিত নারী বিয়েকে প্রয়োজনীয় ভাবেন। ২০১০ সালে এই হারটি ছিল ৪৬.৮ শতাংশ। সরকারি হিসাবে, জন্মহারের দিক থেকে পৃথিবীর অন্যতম পিছিয়ে পড়া একটি দেশ দক্ষিণ কোরিয়া।
দেশটি জনসংখ্যার দিক থেকে একরকম টাইম বোমার মুখোমুখি হচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে তাদের জনসংখ্যার প্রায় এক চতুর্থাংশের বয়স কমপক্ষে ৬৫ হবে। পরিবার দায়িত্ব না নিলে এসব প্রবীণ জনগোষ্ঠীর দেখভাল কে করবে, তা নিয়ে ইতিমধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।
৪৮ বছর বয়সী পার্ক ইন-সিয়ং তাঁর অসুস্থ মায়ের দেখাশোনা করেন। আন্তর্জাতিক বিবাহ সংস্থাগুলোর মাধ্যমে বেশ কয়েকবার বিয়ের জন্য পাত্রী খোঁজার চেষ্টা করেছেন তিনি। লাভ হয়নি। পার্ক বলেন, ‘বাস্তবতার দিক থেকে দেখলে কোরিয়ার কোনো মেয়েই আমাকে বিয়ে করবে না। কারণ, আমাকে বিয়ে করলে স্বাভাবিকভাবেই আমার মাকে দেখার দায়িত্বও তার নিতে হবে।’
কয়েক দশক ধরে গ্রামাঞ্চলের নারীরা কাজের সন্ধানে শহরমুখী হওয়ায় সেসব এলাকায় এই সমস্যা আরও বেড়ে যাচ্ছে।
তবে ঘর-সংসারের দেখাশোনা করে, অর্থ উপার্জন করে ‘আদর্শ’ বউ হওয়া এই নারীরা কেমন আছেন, তা একটি প্রশ্ন বটে। এমা যে টাকা আয় করেন, তার একটি অংশ আলাদা করে জমিয়ে রাখেন। ছয় বছর হলো মা-বাবার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়নি। তিনি শ্বশুর-শাশুড়ির জন্য খেটে মরলেও, স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীর মা-বাবার প্রতি কতটুকু শ্রদ্ধাবোধ কাজ করে, তা ভাবার বিষয়।
জাপানের হোক্কাইদো বিশ্ববিদ্যালয়ের জননীতিবিষয়ক অধ্যাপক হুনজু নাওমি চি বলেন, হায়বু পুরস্কারটি তথাকথিত জেন্ডার ভূমিকার প্রতিনিধিত্ব করে। ভাবটা এমন যেন পরিবারের একমাত্র তত্ত্বাবধায়ক হয়ে ঘর-বাইরের সব কাজ সামলানোর দায়িত্ব নারীদেরই। তিনি বলেন, অভিবাসী নারীদের এই পুরস্কার দেওয়া আরও বেশি হাস্যকর। এ পুরস্কার যেন বলতে চাইছে, কোরিয়ায় সংসার করতে চাইলে আপনাকে এমন ‘আদর্শ নারী’ হতেই হবে, সবার মন জুগিয়ে চলতে হবে।