ভারতে পালিয়ে আসা মিয়ানমারের পুলিশ সদস্যরা যা বললেন
‘বিক্ষোভকারীদের গুলি করতে বলা হয়েছিল আমাকে। কিন্তু আমি তাদের বলেছি পারব না।’ —৯ বছর ধরে মিয়ানমারের পুলিশ বাহিনীতে কাজ করা এই সদস্য এখন জীবন বাঁচাতে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মিজোরাম রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁর নাম নাইং (ছদ্মনাম)।
সম্প্রতি মিয়ানমারে সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখলের পর দেশটিতে বিক্ষোভ চলছে। নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে এখন পর্যন্ত বিক্ষোভে ৭০ জন নিহত হয়েছেন। এরই মধ্যে জান্তাদের নির্দেশ মানতে না পেরে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে মিয়ানমারের সামরিক সরকারও ভারতকে চিঠি দিয়ে তাঁদের ফেরত পাঠাতে অনুরোধ জানিয়েছে। সম্প্রতি তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন বিবিসির এক সাংবাদিক। তাঁরা বয়সে তরুণ। এ নিয়ে গতকাল বিবিসি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনটিতে ওই সব পুলিশ সদস্যের নিরাপত্তার স্বার্থে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।
২৭ বছর বয়সী নাইং একজন নিম্নপদস্থ কর্মী। তিনি বলেন, বিক্ষোভকারীদের ওপর দুইবার গুলি করার নির্দেশ অমান্য করে তিনি পালিয়েছেন। ‘আমি আমার বসকে বলেছি, আমি এটা করতে পারব না এবং আমি সাধারণ মানুষের সঙ্গে আছি। সামরিক বাহিনীর সদস্যরা এতে খুব স্বচ্ছন্দ ছিলেন না। তাঁরা দিন দিন নির্দয় হয়ে উঠছিলেন।’
নাইং কথা বলতে বলতে তাঁর ফোন বের করে স্ত্রী ও ছোট্ট দুই মেয়ের ছবি দেখান, যাঁদের তিনি ফেলে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘আর কখনো তাদের সঙ্গে দেখা হবে কি না, আমি জানি না।’
আরেক পুলিশ কর্মকর্তা লেন, ‘আমি খুব ভয় পাচ্ছিলাম যে আমাকে দিয়ে জোর করে বিক্ষোভে থাকা নিরপরাধ মানুষকে না গুলি করানো হয়। একটি নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে সেনাবাহিনী ভুল করেছে বলে আমরা মনে করি।’
তিয়ায়ু নদী পার হয়ে ভারতে ঢুকেছেন তাঁরা
স্থানীয় কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, সেনা অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমার থেকে শতাধিক ব্যক্তি পালিয়ে মিজোরামে এসেছেন। যাঁদের সঙ্গে বিবিসি কথা বলেছে, তাঁরা তিয়ায়ু নদী পার হয়ে ভারতে ঢুকেছেন। ২৫০ মাইল বিস্তৃত এই নদী সেখানে ভারত ও মিয়ানমারের জলসীমা। তাঁদেরই আরেকজন হুতুত।
জান্তাদের ক্ষমতা দখলের সেই রাতের স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হলো এবং তিনি যে পুলিশ স্টেশনে কাজ করেন, তার পাশেই বসানো হয় সেনাচৌকি। ‘কয়েক ঘণ্টা পর আমরা জানতে পারলাম, সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে।’
পাঁচজনের বেশি বিক্ষোভকারীকে একসঙ্গে দেখলেই গুলির নির্দেশ
২২ বছরের হুততসহ অন্য পুলিশদের সেনাসদস্যদের সঙ্গে একসঙ্গে সড়কে টহল দিতে হতো। সড়কে বিক্ষোভকারীরা শান্তিপূর্ণভাবে তাঁদের কর্মসূচি পালন করলেও তাঁদের গ্রেপ্তারে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। হুতত বলেন, ‘দায়িত্ব থাকা সেনা কর্মকর্তা আমাদের নির্দেশ দিলেন পাঁচজনের বেশি বিক্ষোভকারীকে একসঙ্গে দেখলেই গুলি করতে। আমি জানি, তাঁদের বেধড়ক মারধর করা হয়। আমি রাতে ঘুমাতে পারতাম না। আমি যখন লোকজনকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতাম, আমার মন কোনোভাবেই এই ঘৃণ্য অপকর্মে জড়িত হতে সায় দিত না।’
হুতাত বলেন, তাঁর কর্মস্থল থেকে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি পালিয়েছেন। আতঙ্ক নিয়ে মোটরসাইকেলে করে গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে ভারতে সীমান্ত পৌঁছেছেন তিনি। তাঁর মতো পালিয়ে আসা দলে রয়েছেন দুই নারী পুলিশও। তাঁদের একজন গ্রেস (ছদ্মনাম) বলেন, তিনি দেখেছেন বিক্ষোভকারীদের ওপর সেনারা কীভাবে লাঠি ব্যবহার করেছে, রাবার বুলেট ছুড়েছে। এমনকি শিশুরা ছিল, এমন একটি গ্রুপের ওপর কাঁদানে গ্যাসের শেলও ছুড়েছে।
এখন রীতিনীতি পাল্টে গেছে
গ্রেস বলেন, ‘তারা (জান্তা) চেয়েছে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে আমরা আমাদের বন্ধুদের গ্রেপ্তার করি, কিন্তু আমরা তা করতে পারিনি। আমরা পুলিশ বাহিনীকে ভালোবাসি, কিন্তু এখন রীতিনীতি পাল্টে গেছে, আমরা আমাদের চাকরিটা করতে পারব না।’
২৪ বছরের আরেক নারী পুলিশ সদস্য বলেন, তিনি তাঁর গুরুতর অসুস্থ মাকে ফেলে আসতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা মা–বাবা বৃদ্ধ, তাঁরাও ভয়ে আছেন। কিন্তু আমাদের পালিয়ে আসা ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না।’
তবে মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গা বলেছেন, যাঁরা পালিয়ে এখানে এসেছেন, তাঁদের সাময়িক আশ্রয় দেওয়া হবে। কেন্দ্রীয় সরকার সিদ্ধান্ত নেবে তাঁদের বিষয়ে কী করা হবে।
শুধু যে পুলিশ সদস্যরাই পালিয়েছেন তা নয়, এক দোকানিও এসেছেন। গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনে যোগ দিতে অনলাইনে সমর্থকদের উৎসাহ দেওয়ার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। তিনি বলেন, ‘আমি স্বার্থপরের মতো পালিয়ে আসিনি। দেশে সবাই খুব উদ্বেগের মধ্যে আছে। আমি এখানে নিরাপত্তার খাতিরে এসেছি এবং এখান থেকে আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন জুগিয়ে যতটুকু করতে পারি তা করব।’