বৈধতা প্রতিষ্ঠায় যেভাবে ধর্মকে ব্যবহার করছে মিয়ানমারের জান্তা
মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের এক বছরের মাথায় দেশটিতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বৌদ্ধমূর্তি স্থাপনের পরিকল্পনা করছে সেনা সরকার। সেনা সরকারের প্রধান মিন অং হ্লাইং নিজেকে বৌদ্ধধর্মের সুরক্ষাকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে যেসব প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন, তারই একটি এটি। তবে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মনে করেন, এগুলো সবই লোকদেখানো। মূলত নিজেদের বৈধতা নিশ্চিত করে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার বাসনা থেকে মিন অং হ্লাইংয়ের নেতৃত্বাধীন সেনা সরকার এসব করছে। এর মধ্য দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছে তারা।
মিয়ানমারে গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী। গ্রেপ্তার করা হয় অং সান সু চিসহ তাঁর দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) শীর্ষ নেতাদের। অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার ইতি টানা হয়। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী সংঘাত এবং অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভ। গত বছর অভ্যুত্থানের বিরোধিতাকারীদের ওপর দমন-পীড়ন চালাতে গিয়ে প্রায় দেড় হাজার মানুষকে হত্যা করেছেন সেনাসদস্যরা। আর তা বৌদ্ধধর্মের প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতির লঙ্ঘন। কারণ, বৌদ্ধধর্মে হত্যা থেকে বিরত থাকার কথা বলা হয়েছে।
অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে মান্দালয়ে চলা বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ৩০ বছর বয়সী ভিক্ষু আগা ওয়ানথা। কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল-জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘তারা বৌদ্ধধর্মের চর্চা নিয়ে চাতুরতা করছে। তাদের বৌদ্ধ বলা যায় না। আমরা (বৌদ্ধরা) অন্য মানুষদের হত্যা করি না। তারা এখন যা করছে, সবকিছুই বৌদ্ধধর্মের পরিপন্থী আচরণ। অথচ তারা নিজেদের বৌদ্ধ বলে পরিচয় দিচ্ছে। আসলে তারা দেশের ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতেই এসব করছে।’
এক দিকে মঠ পরিদর্শন, অপর দিকে উচ্ছেদ অভিযান
৯০ শতাংশ বৌদ্ধ অধ্যুষিত দেশ মিয়ানমারে নিজেদের বৈধতা আদায়ের জন্য বৌদ্ধদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সেনা সরকারের প্রধান মিন অং হ্লাইং। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি। নিয়মিত বিভিন্ন মঠ পরিদর্শনেও যাচ্ছেন। পাশাপাশি চলছে সেনাবিরোধী বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা।
অক্টোবরের শেষের দিকে উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় চিন রাজ্যের থান্তল্যাংয়ে ‘শত্রুদের জমায়েত’ ঠেকাতে অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনী। বিভিন্ন স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। লাখো মানুষ তাঁদের বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন।
কয়েক দিন পর মিন অং হ্লাইং মান্দালয় শহরের বেশ কয়েকটি মঠ পরিদর্শন করেন। সেখানে প্রণাম করার পর দান–খয়রাত করেন তিনি। মঠ পরিদর্শনে গিয়ে তিনি যে ভিক্ষুদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাঁদের একজন ভামো সায়াদো। উচ্চপর্যায়ের ভিক্ষুদের নিয়ে সরকারিভাবে গঠিত স্টেট সংঘ মহানায়ক কমিটির চেয়ারপারসন ভামো। এ কমিটির কাজ হলো মিয়ানমারে বৌদ্ধধর্ম ও ধর্মগুরুদের তদারক করা।
জনসংযোগ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে উচ্চপর্যায়ের মঠগুলোতে সেনা নেতৃত্বের পরিদর্শনের খবর প্রায় প্রতিদিনই রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে দেখা যায়। সংঘাত নিরসন করে বিশ্বজুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করা মার্কিন সংস্থা ইউনাইটেড স্টেটস অব পিস গত মাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের পর বৌদ্ধধর্মের প্রতি সেনাবাহিনীর সমর্থন প্রদর্শনের প্রবণতা চার ধাপ বেড়েছে।
মিয়ানমারভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিদাংসু ইনস্টিটিউট ফর পিস অ্যান্ড ডায়ালগের প্রতিনিধি সাই থেত নাইং ও বলেন, নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়াতে খুব চাতুর্যের সঙ্গে ধর্মের ব্যবহার করছে সেনাবাহিনী। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা সমাজে অনেক শ্রদ্ধার পাত্র। আর এ কারণে সেনাবাহিনী তাঁদের ব্যবহার করতে চায়। সমাজের মানুষকে প্রভাবিত করতে তাঁদের (ভিক্ষু) খুব কার্যকর হাতিয়ার মনে করে তারা।
মিয়ানমারে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক কণ্ঠস্বরকে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে পিদাংসু ইনস্টিটিউট ফর পিস অ্যান্ড ডায়ালগ। এর প্রতিনিধি সাই থেত নাইং ও আরও বলেন, মিন অং হ্লাইংয়ের আরও অনেক কাজ করার থাকলেও তিনি সব সময়ই জনপ্রিয় মঠ পরিদর্শনে বেশি সময় দিচ্ছেন।
‘প্রায় সবাই তাদের ঘৃণা করে’
দেশটির বেসামরিক নেতা অং সান সু চি ও তাঁর দলকে গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করার পর তুমুল বিরোধিতার মুখে পড়ে সেনাবাহিনী। অভ্যুত্থানের পরপরই তুমুল বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। অভ্যুত্থানের বিরোধিতায় ছায়া সরকারের সামরিক শাখা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে পিপলস ডেমোক্রেটিক ফোর্স (পিডিএফ)। তখন থেকে নিয়মিতই মিয়ানমারের বিভিন্ন জায়গায় সেনাবাহিনীর সঙ্গে পিডিএফ সদস্যদের প্রায়ই সংঘর্ষ হচ্ছে।
আন্তর্জাতিকভাবেও চাপের মধ্যে রয়েছে সেনা সরকার। বিভিন্ন দেশ তাদের বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বেশ কয়েক সদস্য ও সেনা মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে সেনা কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দেয়, তারা কট্টর বৌদ্ধ ভিক্ষু অশিন উইরাথুকে মুক্তি দিয়েছে। বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন অশিন। বিশেষ করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রদানের জন্য পরিচিত তিনি।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মিয়ানমারবিষয়ক উপদেষ্টা রিচার্ড হোরসি বলেন, দেশের ভেতরে প্রতিরোধের মুখে থাকা সেনাবাহিনী এখন নিজেদের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য মরিয়া হয়ে আছে। হোরসি বলেন, উইরাথুর সঙ্গে সামান্য দূরত্ব বজায় রেখে চলে সেনাবাহিনী। এখনো পুরোপুরিভাবে বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী অ্যাজেন্ডার সঙ্গে গা ভাসিয়ে দেয়নি তারা। তবে সেনাবাহিনী চায় কট্টরপন্থী বৌদ্ধদের নিজেদের হাতে রাখতে।
আল-জাজিরাকে হোরসি আরও বলেন, তাদের (সেনাবাহিনী) অনেক বেশি বন্ধু নেই। প্রায় সবাই যখন তাদের ঘৃণা করছে, সেখানে আর বন্ধু নির্বাচনে বাছবিচার করতে চাইছে না সেনাবাহিনী। স্পষ্টতই বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীদের খেলার একটি কার্ড হিসেবে ব্যবহার করতে পারে তারা। এটি এমন একটি জায়গা, যেখানে তারা সহজে পৌঁছাতে পারে।
নিজেদের বৈধতা আদায়ের কৌশল হিসেবে বৌদ্ধধর্ম ও বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদকে ব্যবহারের এ প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক পর্যায়েও চালাচ্ছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। গত বছরের সেপ্টেম্বরে একটি অস্ত্র চুক্তি তদারক করতে মিন অং হ্লাইংয়ের সেকেন্ড ইন কমান্ড জেনারেল সোয়ে উয়িন রাশিয়া সফরে গিয়েছিলেন। কট্টর ভিক্ষু সিতাগু সায়াদোকে তখন তাঁর সফরসঙ্গী হিসেবে দেখা গিয়েছিল।
হোরসি মনে করেন, সিতাগুকে সফরসঙ্গী হিসেবে নিয়ে যাওয়ার পেছনে ‘আস্থা অর্জনের’ ইস্যু থাকতে পারে। হোরসি মনে করেন, বৌদ্ধ ভিক্ষুকে সঙ্গে নিয়ে ভ্রমণ করার মধ্য দিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনী হয়তো প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে, তাদের প্রতি ধর্মীয়ভাবে সমর্থন আছে। এ সিতাগুই ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিধন অভিযান চলার সময় নানা বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিয়েছিলেন। সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডকে সমর্থন জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘যাঁরা বৌদ্ধ নন, তাঁরা মানুষ নন। তাঁদের মেরে ফেলাটা যুক্তিসংগত।’
মিয়ানমার সেনাবাহিনী পুরোপুরিভাবে বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদকে আলিঙ্গন না করলেও দেশটির বিভিন্ন অংশে অন্য ধর্মের মানুষের ওপর হামলা আবারও শুরু করতে দেখা গেছে তাদের।
পিদাংসু ইনস্টিটিউট ফর পিস অ্যান্ড ডায়ালগের প্রতিনিধি সাই থেত নাইং ও বলেন, ‘আপনারা খেয়াল করলে দেখতে পাবেন, সম্প্রতি অবৌদ্ধ অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে সশস্ত্র সংঘাত বাড়তে দেখা গেছে। ভিন্ন ধর্মের মানুষের ওপর হামলার কথা সেনাবাহিনী বলছে না। অথচ তাদের (অন্য ধর্মের মানুষ) লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে।’
ধর্মীয় বৈষম্য
সেনা সরকার নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন নিবন্ধে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হত্যার জন্য পিডিএফ যোদ্ধাদের দায়ী করা হয়েছে। অভ্যুত্থানের আগেও সেনাবাহিনী অং সান সু চি ও তাঁর দল এনএলডিকে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি কম মনোযোগী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। অভ্যুত্থানের পরও সে ধারা অব্যাহত আছে
আগস্টে দেওয়া এক বক্তব্যে মিন অং হ্লাইং বলেন, গত পাঁচ বছর বৌদ্ধ ধর্মপ্রাণদের বিশ্বাসের ওপর আঘাত করা হয়েছে। মূলত গত পাঁচ বছর বলতে এনএলডি সরকারের শাসন মেয়াদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে।
সেনাবিরোধী বিক্ষোভে নেতৃত্বদানকারী ভিক্ষু আগা ওয়ানথা বলেন, অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভে ভিক্ষুদের উপস্থিতি কম থাকার মানে এটা নয় যে তাঁরা সেনাবাহিনীকে সমর্থন করেন। বরং তিনি মনে করেন, কোভিড-১৯ মহামারি পরিস্থিতির কারণে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের অনেকে বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছেন না। আবার সেনাসংশ্লিষ্ট ভিক্ষুদের অধীন থাকা ব্যক্তিরাও উপস্থিত হতে পারছেন না।
আগা ওয়ানথা বলেন, ‘সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে মিন অং হ্লাইং ঘুষ দিয়ে অনেক ভিক্ষুকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে গেছেন। তবে আমরা চাই না যে সাধারণ মানুষ এটা ভাবুক, আমরা সেনাবিরোধী বিক্ষোভের সমর্থক নই। আমরা ভিক্ষুরাও সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলকে সমর্থন করি না।’
আগা ওয়ানথা আরও বলেন, ‘তারা ক্ষমতায় থাকায় আমাদেরও ভুগতে হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নামলে আমাদের ওপর গুলি চালানো হয়। ভাগ্য খারাপ হলে গ্রেপ্তারও হতে হয়। বৌদ্ধরা এ ধরনের কাজ করতে পারে না। আর তাই আমরা বিক্ষোভ চালিয়ে যাব।’
তথ্যসূত্র: আল–জাজিরায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অবলম্বনে