বিতর্কিত হীরা ব্যবসায়ী গার্টলারের কাঁধে মোসাদের হাত
ইসরায়েলের অন্যতম ধনী ব্যবসায়ী তিনি। করেন হীরার ব্যবসা। তেল আবিবের ইসরায়েল ডায়মন্ড এক্সচেঞ্জ থেকে পরিচালিত হয় তাঁর এ ব্যবসা। থাকেন তেল আবিবেরই এক অভিজাত এলাকায়। তবে ইসরায়েলিদের কাছে খুব বেশি পরিচিত নন। যদিও আফ্রিকায় ‘পরিচিত মুখ’। তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গোয় (ডিআরসি) হীরার ব্যবসার পরিধি যত বাড়িয়েছেন, বিতর্কও তত ছড়িয়েছেন। বলা হচ্ছে ড্যান গার্টলারের (৪৮) কথা।
হীরা ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান গার্টলার যা করেছেন, তা রীতিমতো তাক লাগানো ব্যাপার। ইসরায়েল ও কঙ্গো—দুই দেশেরই শীর্ষ নেতৃত্বের ‘আশীর্বাদ’ পেয়েছেন বিতর্কিত এই ব্যবসায়ী। কিন্তু কেন? ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট সেই রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করেছে।
১৯৯০-এর দশক থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গোতে ব্যবসা শুরু করেন গার্টলার। প্রেসিডেন্ট ও তাঁর সন্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক ও ঘনিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে দেশটিতে বেশ কয়েকটি হীরার খনি কিনেছেন। ১৯৯৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশটিতে পর্যায়ক্রমে প্রেসিডেন্ট ছিলেন লরেন্ট কাবিলা ও তাঁর ছেলে জোসেফ কাবিলা। দুজনের সঙ্গেই তাঁর সমান ঘনিষ্ঠতা। তাঁর আগ্রহ ছিল নানা কৌশলে হীরা, তামা ও কোবাল্টের খনি দখলের ওপর।
গার্টলারকে ঘিরে ছিল অনেক বিতর্ক, বিশেষ করে তাঁর ব্যবসার অস্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে ঢের। ২০১৭ সালে মার্কিন রাজস্ব বিভাগ তাঁর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। যে আইনের অধীন এ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়, সেটির আওতায় অভিযুক্ত অপরাধী বা দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সম্পদ জব্দ করা যেতে পারে। গার্টলারের বিরুদ্ধে কঙ্গোতে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া ও দুর্নীতির মাধ্যমে খনি ও তেল চুক্তি করে সম্পদ অর্জনের অভিযোগ তোলে যুক্তরাষ্ট্র। এ ক্ষেত্রে তিনি প্রেসিডেন্ট জোসেফ কাবিলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সম্পর্ক কাজে লাগান। দেশটির খনি বিক্রির ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী হিসেবেও ভূমিকা পালন করেন তিনি।
কিন্তু সম্প্রতি ইসরায়েলের নাগরিকদের কাছে গার্টলার বিষয়ে মনোযোগ কেড়েছে দেশটির হারেৎজ পত্রিকার একটি প্রতিবেদন। তাতে বলা হয়েছে, গার্টলারকে সম্পদের দানব হয়ে উঠতে সাহায্য করেছেন দেশটির সাবেক সরকারপ্রধান বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আমলের কয়েকজন ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তাঁদের মধ্যে সামনে এসেছে ইয়োসি কোহেনের নাম। কোহেন ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সাবেক পরিচালক।
হারেৎজ বলছে, ২০১৯ সালে তিনবার কঙ্গো সফর করেছিলেন কোহেন। এর কারণ ছিলেন শুধুই গার্টলার। প্রেসিডেন্ট জোসেফ কাবিলা ও তাঁর উত্তরসূরি ফেলিক্স শিসেকেডির সঙ্গে গার্টলারের পক্ষে মধ্যস্থতা করতে মোসাদ পরিচালক ওই সফর করেন। তবে গার্টলারের পক্ষ থেকে অনৈতিক কোনো কিছু করার অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, বিশ্বের কোনো দেশে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই।
গত বছর অবসরে গেছেন মোসাদ পরিচালক কোহেন। গার্টলারের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বের বিষয়টি এ ইঙ্গিত দেয় যে তাঁরা ইসরায়েলের স্বার্থেই কিছু চুক্তি করেছিলেন। তবে অন্য গোয়েন্দা সংস্থার মতো মোসাদ স্থানীয় সংযোগ ও প্রভাব খাটানো এজেন্ট (হেল্পার্স) ব্যবহার করে কাজ করে। বিপদে পড়লে তাঁদের উদ্ধারের কাজও করে থাকে। তবে আফ্রিকার একটি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশে মোসাদের মতো একটি সংস্থার প্রধানের তিনবার সফর নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
গার্টলারের সাহায্যকারীদের মধ্যে আরেকজন হচ্ছেন কঙ্গোর সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডন ডারমার। তিনি বলেছেন, ওই অঞ্চলে ইসরায়েলের স্বার্থের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল গার্টলারের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি। তাঁকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থেকে বের করাটাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ মিত্রদের মধ্যে ছিলেন ডারমান ও কোহেন। দুজনই নেতানিয়াহু সরকারের গোপন মিশন বাস্তবায়নে কাজ করছেন। নেতানিয়াহু তাঁদের অনেক সময় নিজের উত্তরসূরি হিসেবেও আখ্যা দিয়েছেন। কাকতালীয়ভাবে, বর্তমানে দুর্নীতির মামলায় লড়তে থাকা নেতানিয়াহুর আইনজীবী ও গার্টলারের আইনজীবীও একই ব্যক্তি।
ইসরায়েলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেটের সরকার বলছে, কোহেন স্বল্প সময়ের জন্য মোসাদ প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন। সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে সংস্থাটির সঙ্গে গার্টলারের কোনো সম্পর্ক নেই। গার্টলারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল আগের সরকারের।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গার্টলারকে নিষেধাজ্ঞার তালিকায় রাখলেও হোয়াইট হাউস ছাড়ার আগে তাঁর জন্য বিশেষ ছাড় দিয়ে গেছেন। কিন্তু বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গার্টলারের ওপর ততটা প্রসন্ন নন। তবে ইসরায়েলি প্রেসিডেন্ট নাফতালি বেনেট জো বাইডেনকে সন্তুষ্টই রাখতে চান। একই সঙ্গে বেনেট চান আফ্রিকার সঙ্গেও ইসরায়েলের সম্পর্ক ভালো থাকুক, যেমনটা রেখেছিল আগের সরকার। তবে আফ্রিকায় গার্টলারকে সবাই ভালোভাবে মেনে নিচ্ছেন না।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মো. মিন্টু হোসেন