নিউইয়র্ক টাইমসের ১৩ মে শুক্রবার প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম ছিল, ‘ফিলিস্তিনি সাংবাদিকের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে ইসরায়েলি পুলিশের হামলা’, যা পরে হালনাগাদ করে লেখা হয়েছিল, ‘ফিলিস্তিনি সাংবাদিকের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় শোকার্তদের ওপর ইসরায়েলি পুলিশের হামলা’। এ শেষকৃত্য ছিল ৫১ বছর বয়সী আল-জাজিরার অভিজ্ঞ সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহর। দখলকৃত পশ্চিম তীরে ১১ মে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে নিহত হন তিনি।
ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরায়েলি পুলিশের কর্মকর্তারা জেরুজালেমে শিরিন আবু আকলেহর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের আগে শোকমিছিলে ‘শোকার্তদের লাঠিপেটা করেছিলেন ও লাথি মেরেছিলেন’। পাশাপাশি ‘প্যালবেয়ারদের (কফিন বহনকারী) একরকম কফিন ফেলতে বাধ্য করেছিলেন’ তাঁরা। এর আগে আবু আকলেহ নিহত হওয়ার খবর জানাতে মার্কিন সংবাদমাধ্যমটি ‘৫১ বছর বয়সে মারা যায়’ বাক্যাংশ ব্যবহার করে।
মার্কিন পত্রিকাটি এ ধরনের শিরোনাম আগেও করেছে। যেমন ২০১৪ সালে গাজা উপত্যকায় ফুটবল খেলতে থাকা চার ফিলিস্তিনি শিশুকে হত্যা করে ইসরায়েলি বাহিনী। তখন নিউইয়র্ক টাইমসের শিরোনাম ছিল, ‘ছেলেরা গাজা সৈকতে গেল, আর মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে উত্তেজনা ছড়াল’। আবু আকলেহ হত্যাকাণ্ড নিয়ে ১৩ মে তাদেরই প্রকাশ করা প্রতিবেদনের একটি লাইন ছিল, ‘সাংবাদিকের শেষকৃত্যে প্রায় পড়ে গেল কফিন, দুঃখজনক রূপায়ণ ঘটল ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের’।
নারী সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহ তাঁর নিবেদিত কর্মজীবনে নিজেকে ফিলিস্তিনি মানবতার সঙ্গে অঙ্গীভূত করেছেন, শক্তিশালী পক্ষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সত্য বলেছেন। পরিণামে দখলদার শক্তি (ইসরায়েলি বাহিনী) মাথায় গুলি করে হত্যার মধ্য দিয়ে তাঁর কণ্ঠকে থামিয়ে দিয়েছে। এখানেই শেষ নয়; আবু আকলেহর জন্য শোক পালনকারীদের আক্রমণ করা হয়েছে। এমন প্রতিক্রিয়াকে দখলদার ইসরায়েলের প্রচণ্ড ও বহুস্তরযুক্ত রাষ্ট্রীয় বর্বরতা হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা যেতে পারে। ফিলিস্তিনিদের বাঁচা–মরা, এমনকি শান্তিতে সমাহিত করার ক্ষেত্রে ইসরায়েল যে মনোভাব পোষণ করে আসছে; আবু আকলেহর ক্ষেত্রেও তারই প্রতিফলন ঘটেছে।
মরার পর ফিলিস্তিনিদের শান্তিতে সমাহিত থাকার বিষয়েও আপত্তি ইসরায়েলের। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় কবরস্থানেও বোমা হামলা চালিয়েছিল, যাতে করে মৃতদের হাড়গুলো পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে যায়।
শেষকৃত্যে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা অবশ্য নতুন কিছু নয়। কারণ, অ্যাম্বুলেন্স, হাসপাতাল, চিকিৎসাকর্মী, বিদ্যালয়, জাতিসংঘের ভবন, বহুতল ভবন, প্রাণী, গাছ, শিশু—হেন কিছু নেই যা লক্ষ্য করে ইসরায়েল হামলা করতে পারে না।
স্মরণ করা যেতে পারে ২০২১ সালের ২৯ জুলাই, ১২ বছর বয়সী মোহাম্মদ আল-আলামির জানাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার কথা। তার আগের দিন পশ্চিম তীরের বেইত ওমর শহরে বাবার সঙ্গে গাড়িতে ভ্রমণের সময় ইসরায়েলি সেনারা আলামির বুকে গুলি চালিয়ে হত্যা করেন। আলামির জানাজাকে কেন্দ্র করে ইসরায়েলি হামলায় নিহত হন ২০ বছর বয়সী শওকত আওয়াদ।
শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার ঘটনা আরও রয়েছে। ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে চলতি বছরের ২ মার্চ নিহত হন হেবরনের উত্তরে অবস্থিত আল-আরুব শরণার্থীশিবিরের ১৯ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি ছাত্র আম্মার আবু আফিফা। ইসরায়েলি বাহিনী তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানেও হামলা চালিয়েছিল। তখন এ ঘটনায় উগ্র ইহুদিবাদী সংগঠন দ্বারা পরিচালিত টাইমস অব ইসরায়েল সংবাদ শিরোনাম করতে বাধ্য হয়, ‘ইসরায়েলি সেনারা এক ফিলিস্তিনি তরুণকে গুলি করে হত্যা করেছে। তিনি কী ভুল করেছেন, তা সেনাবাহিনী বলেনি।’
সাংবাদিক শিরিনের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের দুই মাস পেছনে ফেরা যাক। তখন এমনই এক শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানে ইসরায়েলি পুলিশের সহিংস আচরণের ফুটেজ নিয়ে কথা বলেছেন হোয়াইট হাউসের বিদায়ী প্রেস সেক্রেটারি জেন সাকি। তিনি ওই ঘটনাকে বলেছেন ‘অত্যন্ত বিরক্তিকর’। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এমন নিন্দা জানানোর বিষয়টি বিরল। কারণ, ইসরায়েলি বাহিনী এমন ঘটনা নিয়মিত ঘটালেও যুক্তরাষ্ট্র সেগুলোতে এমন প্রতিক্রিয়া জানায় না।
যা–ই হোক, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘকাল ধরে একই কর্মের সারথি। ইসরায়েলি এমন নৃশংসতার ভৌগোলিক তাৎপর্য আরও গভীর। ঘটনাচক্রে, শিরিনকে জেরুজালেমে সমাহিত করার মাত্র দুই দিন পর ১৫ মে ছিল নাকবার ৭৪তম বার্ষিকী। দিনটিতে ফিলিস্তিনিরা ১৯৪৮ সালে তাদের ভূমিতে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য শোক প্রকাশ করে থাকে। ইসরায়েল তাদের দখলদারি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সে সময় ৫ শতাধিক ফিলিস্তিনি গ্রাম ধ্বংস, ১০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা এবং সাড়ে ৭ লাখের বেশি ফিলিস্তিনিকে বাস্তুচ্যুত করে। ইসরায়েলের শুরু করা সেই রক্তক্ষয়ী কর্মকাণ্ড আজও চলছে।
ইসরায়েলের জন্য দুর্ভাগ্য যে বন্দুকের নল দিয়ে ফিলিস্তিনিদের পরিচয় মুছে ফেলা যাবে না, ফিলিস্তিনিরাও আপনা–আপনি তাদের অস্তিত্ব জলাঞ্জলি দেবে না। শিরিনের শেষকৃত্যে ফিলিস্তিনিরা তাদের পতাকা বহন করেছিল। আর এ জন্য এই শোকসন্তপ্ত ফিলিস্তিনিদের অনেককে গ্রেপ্তার করে ইসরায়েলি বাহিনী। এই আচরণের মধ্য দিয়ে ইসরায়েল তাদের তুলে ধরা মানবতাবাদী ভাবমূর্তির কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিল, আর সত্য কথা হলো, ইসরায়েলের এই ছদ্ম মানবতা আগেই কবর দেওয়া উচিত ছিল।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মো. ছানাউল্লাহ