পাকিস্তানের রাজনীতি: নারীদের হেনস্তার সংস্কৃতি কি নতুন
রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী এবং পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) ভাইস প্রেসিডেন্ট মরিয়ম নওয়াজকে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে পাকিস্তানি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তুমুল সমালোচনার মধ্যে আছেন। দেশটির নানা শ্রেণি–পেশার মানুষও এর সমালোচনা করেন। তবে দেশটির রাজনীতিতে এ ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পাকিস্তানের বড় দুই রাজনৈতিক দল পিএমএল-এন ও পিটিআই—দুই পক্ষই ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদ্বন্দ্বীকে নিয়ে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য হরহামেশাই দেন নেতারা। অনেক ক্ষেত্রেই এসব বিদ্বেষমূলক মন্তব্যের লক্ষ্যবস্তু হচ্ছেন নারী রাজনীতিবিদেরা।
পাকিস্তানের কিছু কিছু এলাকায় নারীদের দমিয়ে রাখতে অনার কিলিংয়ের মতো নৃশংস কর্মকাণ্ড এবং অন্য পুরোনো প্রথাগুলো ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তাঁদের অধিকারগুলো পূরণ করা হয় না। এ ছাড়া প্রভাবশালী নারীদের হেয় করতে পুরুষ প্রতিদ্বন্দ্বীরা বিভিন্ন আক্রমণাত্মক ও বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করে থাকেন।
সর্বশেষ এ ধরনের দৃশ্য দেখা গেছে গত শুক্রবার। এদিন মুলতানে এক রাজনৈতিক সমাবেশে ইমরান খান বলেন, ‘সারগোধাতে মরিয়াম নওয়াজ যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা আমার কাছে একজন পাঠিয়েছেন। ওই ভাষণে তিনি (মরিয়ম) এমন আবেগ নিয়ে আমার নাম উচ্চারণ করেছেন, আমি তাঁকে বলতে চাই—মরিয়ম, দয়া করে সতর্ক হোন। আপনার স্বামী মন খারাপ করতে পারে; কারণ, আপনি বারবার আমার নাম বলে যাচ্ছিলেন।’
২২ মে পাকিস্তানের স্থানীয় সংবাদমাধ্যম মিনিট মিররে প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ‘রাজনৈতিক বিরোধীদের আক্রমণ করাটা বাগাড়ম্বরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে এর মধ্য দিয়ে কখনোই কোনো ব্যক্তিকে হেয় করা উচিত নয়। যে দেশের ৪৮ শতাংশই নারী, সে দেশের রাজনীতিবিদেরা নারীকে হেয় ও অমর্যাদা করে কীভাবে সে দেশের নেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন।’
মিনিট মিররের সম্পাদকীয়তে আরও বলা হয়, পূর্ববর্তী সময়ে বিভিন্ন সাক্ষাৎকার ও জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণেও নারীদের নিয়ে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিয়েছিলেন ইমরান। পাকিস্তানে ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার জন্য নারীদের পোশাককে দায়ী করেছিলেন তিনি। পাকিস্তানের চলচ্চিত্রশিল্প ও নাটককে উর্দু ভাষায় ‘ফাহাসি’ (পর্নো) বলে উল্লেখ করেছিলেন তিনি। এর মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রশিল্পীদের ছোট করা হয়েছিল। উগ্র ডানপন্থী রক্ষণশীল ভোটারদের সন্তুষ্ট করতে গিয়ে বারবারই নারীদের নিয়ে আপত্তিজনক বক্তব্য দিতে দেখা গেছে তাঁকে।
শুধু ইমরান খানই নন, অতীতে পাকিস্তানে নারী রাজনীতিবিদদের নিয়ে অনেক পুরুষ রাজনীতিবিদ বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। ২০১৬ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী খাজা আসিফ পিটিআইয়ের জ্যেষ্ঠ নেতা শিরিন মাজারিকে নিয়ে আক্রমণাত্মক মন্তব্য করেছিলেন। তাঁকে ‘ট্রাক্টর ট্রলি’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন তিনি। এর এক বছর পর আরেক পিটিআই নেতা ফিরদৌস আশিক আওয়ানকে ‘ডাম্পার’ বলেছিলেন তিনি।
পিটিআই নেতা ইমরান খান তৃতীয় বিয়ে করার পর তিনি ও তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে পিএমএল-এনের নেতা রানা সানাউল্লাহ অত্যন্ত আপত্তিকর মন্তব্য করেছিলেন।
ইমরানের দলের নেতা সাবেক তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী সম্প্রতি এক টুইটার পোস্টে বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানি খাঁর একজন ‘কম বুদ্ধিসম্পন্ন নারী’। শুধু ব্র্যান্ডের ব্যাগ ও জিনিসপত্র ব্যবহারের কারণেই পরিচিতি পেয়েছেন তিনি।
২০১৬ সালে শিরিন মাজারিকে যখন ‘ট্রাক্টর ট্রলি’ বলে ডাকা হয়েছিল, তখন অনেক পিটিআই সমর্থক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ জানিয়েছিলেন। অথচ ২০১২ সালে ইমরানের সঙ্গে মতগত বিরোধের কারণে পিটিআই থেকে পদত্যাগের সময় একই ধরনের বিদ্রূপের শিকার হয়েছিলেন মাজারি। শুধু তা–ই নয়, শিরিন মাজারির মেয়ে ইমান মাজারিকে নিয়েও বিদ্বেষমূলক প্রচারণা চালিয়েছিলেন তাঁরা। পিটিআই নেতাদের অনেকে তাঁকে ‘যৌনকর্মী’ বলে গালি দিয়েছিলেন। ইমানও পিটিআই ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন তখন। পদত্যাগপত্রে মাজারি উল্লেখ করেছিলেন, কীভাবে তিনি ও তাঁর মেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পিটিআইয়ের কর্মীদের কাছে হেনস্তার শিকার হয়েছিলেন। পরে আবার ২০১৩ সালে পিটিআইয়ে যোগ দেন শিরিন মাজারি।
২১ মে জিও নিউজে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সাম্প্রতিক সময়গুলোতে একটি ইতিবাচক বিষয় দেখা গেছে। যখনই কেউ নারীবিদ্বেষী বক্তব্য দিচ্ছেন, তখনই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা প্রচলিত গণমাধ্যমে তুমুল সমালোচনার শিকার হচ্ছেন তিনি। তবে এতটুকুই যথেষ্ট নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরেও নারী-পুরুষনির্বিশেষে সমালোচনার চর্চা থাকতে হবে। নিজ দলের কর্মীদেরও জনসমক্ষে ক্ষমা চাইতে বলতে হবে তাঁদের।’
রেহাম খান, গুল বুখারি ও মারভি সিরমেদের মতো প্রভাবশালী পাকিস্তানি নারীদেরও টুইটারে বিভিন্ন সময়ে আক্রমণের শিকার হতে দেখা গেছে। একই রকম করে পিটিআইয়ের অনেক সমর্থককে দেখা গেছে মালালা ইউসুফজাইয়ের বিরুদ্ধে বারবারই নোংরা ভাষা ব্যবহার করতে। মালালা ইউসুফজাইকে শান্তিতে নোবেলজয়ী ঘোষণা করার পর পিটিআইয়ের ফেসবুক পেজে বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য দেখা গিয়েছিল। মালালাকে অভিনন্দন জানানোর কারণে অনেকে ইমরানের সমালোচনা করেছিলেন তখন।
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের মেয়ে মরিয়ম নওয়াজকেও বিভিন্ন সময়ে হেনস্তার শিকার হতে দেখা গেছে। একটি অর্ধনগ্ন ছবির ওপর মরিয়ম নওয়াজের মাথা জুড়ে দেওয়া কিছু ছবি টুইটারে পোস্ট করেছিলেন পিটিআইয়ের কর্মীরা। সঙ্গে ক্যাপশনে খুব আপত্তিকর কথা লেখা ছিল।
নারী রাজনীতিবিদকে হেনস্তা করার এ কৌশল ১৯৮০–এর দশকে বেনজীর ভুট্টোর বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিল পিএমএল-এন।
পাকিস্তানের বড় দুই রাজনৈতিক দল পিটিআই ও পিএমএল-এন যখন যৌন হেনস্তা ও বিদ্বেষমূলক সংস্কৃতিকে লালন করছে, তখন নারীদের রাজনীতিতে শামিল হওয়া অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে লৈঙ্গিক ব্যবধান সূচকে পাকিস্তানের অবস্থান যখন একেবারে শেষের কাতারে, তখন এ ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলতে পারে আরও।
গত রোববার দ্য কারেন্টে প্রকাশিত এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ‘অনেক আগে থেকেই পুরুষেরা নারীদের রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছেন। তবে ভয় দেখিয়ে নারীদের থামাতে পারছেন না তাঁরা।’
সূত্র: জিও নিউজ, মিনিট মিরর, এক্সপ্রেস ট্রিবিউন, দ্য কারেন্ট অবলম্বনে ফাহমিদা আক্তার