পক্ষত্যাগী মিয়ানমার সেনা কর্মকর্তার বর্ণনায় প্রতিরোধযোদ্ধাদের বীরত্ব
সেনা অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডো ও আরেক বড় শহর ইয়াঙ্গুনে সেনাবাহিনীর নির্যাতনের চিত্র উঠে এসেছে বিভিন্ন সময়। তবে মিয়ানমারের সাবেক এক সেনা কর্মকর্তা দেশটির শিন প্রদেশে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গড়ে তোলা প্রতিরোধযুদ্ধের নতুন তথ্য সামনে আনলেন।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাবেক ক্যাপ্টেন কং থু উইন। তিনি বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন। এই সেনা কর্মকর্তা শিন প্রদেশে ছিলেন। সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে সেনাবাহিনী, এই খবর শোনার পর বিদ্রোহীদের পক্ষে অবস্থান নেন তিনি। তাঁর দেওয়া তথ্য অনুসারে, ওই প্রদেশের দক্ষিণাঞ্চলে কমপক্ষে ৫০ জন সেনাকে হত্যা করেছেন বিদ্রোহীরা। এ ছাড়া বিদ্রোহীদের হাতে ২০০ জনের বেশি সেনা আহত হয়েছেন। এসব লড়াইয়ে বিদ্রোহীরা ঘরে তৈরি অস্ত্র ব্যবহার করেছেন।
২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি কোনো ধরনের রক্তপাত ছাড়া মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চিকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং দেশটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। এর পর থেকে দেশটিতে বিক্ষোভ শুরু হয়। এই বিক্ষোভ থামাতে দমন–পীড়ন চালায় সেনাবাহিনী। এই দমন–পীড়নে দেড় হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। কোনো কোনো প্রদেশে বিদ্রোহীরা ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তুললেও নির্যাতনের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হন। তবে শিন প্রদেশের চিত্র ছিল ভিন্ন। মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের এই প্রদেশে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়েছেন বিদ্রোহীরা।
এ–সংক্রান্ত বিভিন্ন নথিও বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেখিয়েছেন সাবেক সামরিক কর্মকর্তা কং থু উইন। এ ছাড়া সেখানকার লড়াইয়ের অভিজ্ঞতাও তুলে ধরেছেন তিনি।
বর্তমানে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে রয়েছেন উইন। স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে সেখানে পাড়ি জমিয়েছেন তিনি। নিজের পরিচয়পত্র দেখানোর পাশাপাশি শিন প্রদেশে ঘটে যাওয়া ১২টি ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন উইন। তাঁর দেওয়া বর্ণনা অনুসারে, গত মে থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ওই সব ঘটনা ঘটেছে।
এ ছাড়া রয়টার্সকে ৩০টি গোপন নথি দেখিয়েছেন উইন। এসব নথির ভিত্তিতে হতাহতের হিসাব দিয়েছেন তিনি। এসব নথি থেকে জানা যাচ্ছে, শিন প্রদেশের সাধারণ মানুষ এই জান্তা সরকারের শাসন মেনে নেননি। তাঁরা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষেরা নিজেদের সংগঠিত করে সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তুলেছেন।
শিন প্রদেশের মিনদাত শহরে সেনাবাহিনীর নির্যাতনের বিভিন্ন তথ্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো প্রকাশ করেছে। তবে সেখানকার নতুন চিত্র সামনে এনেছেন এই সেনা কর্মকর্তা। উইন জানিয়েছেন, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সেখানে বিদ্রোহীরা আরও সংগঠিত হচ্ছেন। এ ছাড়া সারা দেশেই এমন বিদ্রোহ বাড়ছে বলে নথি সূত্রে জানা যাচ্ছে।
মিয়ানমারের বিভিন্ন স্থানে লড়াইয়ে সেনাবাহিনী নিজেদের পরাজয়ের কথা বলেছে। হতাহতের বিস্তারিত তথ্য তারা জানাচ্ছে না। এ ছাড়া শিনের নতুন তথ্য সম্পর্কে সেনাবাহিনীকে জিজ্ঞাসা করা হলে তারা কিছু জানায়নি। এ ছাড়া উইনদের মতো সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের আশ্রয় দেওয়ার বিষয়ে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও কোনো মন্তব্য করেনি।
গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি সেনা অভ্যুত্থানের পর মিনদাতে বিদ্রোহীরা সংগঠিত হতে শুরু করেন। উইন বলেন, মিয়ানমারের জান্তা সরকার ওই শহরে ব্যাপক সংখ্যায় সেনা মোতায়েন করে। কারণ, গত ১৪ মে সেনাবাহিনীর একটি বহরের ওপর হামলা চালান বিদ্রোহীরা। ওই বহরে ৭টি গাড়ি ছিল। শহরের কাছেই এই হামলা চালানো হয়। শত শত বিদ্রোহী এই হামলায় অংশ নিয়েছিলেন। ঘটনাস্থলে ৫ সেনা নিহত হন। এ ছাড়া ৩৭ সেনা নিখোঁজ হন।
উইন বলেন, প্রায় এক হাজার বিদ্রোহী ওই হামলায় অংশ নিয়েছিলেন। এতে সেনাদের ছয়টি ট্রাক জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। সেনারা অনেক অস্ত্র হারিয়েছেন এই হামলায়। তিনি বলেন, ১৪ মের ওই হামলায় কমপক্ষে ২০ সেনা প্রাণ হারিয়েছেন।
শিনের দক্ষিণাঞ্চলে বিদ্রোহীদের একটি দল সংগঠিত হয়েছে। তাদের নাম শিনল্যান্ড ডিফেন্স ফোর্স (সিডিএফ)। এই বিদ্রোহীদের ভয়ংকর বলে উল্লেখ করেছেন উইন। তিনি বলেন, মিনদাতের ওই হামলার পর সিডিএফের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেয় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।
মিনদাতের এই হামলা সম্পর্কে উইনের বিস্তারিত জানার কারণ অবশ্য ভিন্ন। কারণ, সেনাবাহিনীর তদন্ত দলের হয়ে কাজ করতেন তিনি। তবে মিনদাতের এই হামলা নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি সেনাবাহিনী।
এদিকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ছাড়ার পর উইনকে নিয়ে বিবৃতিও দিয়েছে সিডিএফ। গত ১০ জানুয়ারির ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, উইন তাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়েছে। তাঁকে ও স্ত্রী-সন্তানকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া অস্ত্রের জন্য তাঁকে অর্থও দেওয়া হয়েছে।
সিডিএফের আরেক শাখা কালায় ডিফেন্স ফোর্সের (সিডিএফ কেকেজি) এক মুখপাত্র বলেন, অস্ত্রের জন্য উইনকে ৩ হাজার ৩০০ মার্কিন ডলার দেওয়া হয়েছে। তবে যে পরিমাণ অস্ত্র দেওয়া হয়েছে, তার মূল্য এর চেয়ে বেশি।
উইন বলেন, মিয়ানমারে গেরিলারা শক্তিশালী হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন স্থানে হামলায় হতাহত হচ্ছেন দেশটির সেনারা। উইনের সঙ্গে সুর মিলিয়ে অনেক বিশেষজ্ঞ মিয়ানমারের পরিস্থিতিকে গৃহযুদ্ধ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছে।
এদিকে হামলায় হতাহতের তথ্য না দেওয়া হলেও হামলার সংখ্যা সম্পর্কে তথ্য দিচ্ছেন জান্তা সরকারের প্রধান মিন অং হ্লাইং। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, গত বছর ৯ হাজারের বেশি হামলা হয়েছে। এগুলোকে তিনি ‘সন্ত্রাসী হামলা’ আখ্যা দিয়েছেন।
উইন বলেন, এসব হামলার পরপরই যেসব সেনার মরদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয় না, তাঁদের নিখোঁজ বলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।
মিয়ানমারে গেরিলা হামলার চিত্র তুলে ধরে গত ২৬ জানুয়ারি একটি বিবৃতি দিয়েছিল সিডিএফ। এতে বলা হয়েছিল, গত বছরের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে শিন প্রদেশে কমপক্ষে ১ হাজার ২৯ সেনা নিহত হয়েছেন। তাদের সদস্য নিহত হয়েছেন ৫৮ জন। আর বেসামরিক মানুষ মারা গেছেন ২৭ জন।
২০০৬ সালে মিয়ানমারের ডিফেন্স সার্ভিস একাডেমিতে যোগ দিয়েছিলেন উইন। এরপর সামরিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে লাইট ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন ২১৬-তে যোগ দেন তিনি। এই পদাতিক বাহিনী কারেন ও শান প্রদেশে কাজ করে। মূলত বিভিন্ন জাতিসত্তার সশস্ত্র গোষ্ঠীকে দমনে তাদের ব্যবহার করা হয়। এরপর ২০১৬ সালে উইনকে শিন প্রদেশে পাঠানো হয়।
রয়টার্স অবলম্বনে: মোজাহিদুল ইসলাম মণ্ডল