জনরোষের মুখে গোতাবায়ার পলায়ন, যা যা ঘটল শ্রীলঙ্কায়

চরম অর্থনৈতিক–রাজনৈতিক সংকটে পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কা
ফাইল ছবি: রয়টার্স

স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। এর রেশ ছড়িয়েছে দেশটির রাজনীতিতেও। জ্বালানিসহ নিত্যপণ্যের তীব্র সংকট ও উচ্চমূল্যে দিশেহারা দ্বীপরাষ্ট্রটির মানুষ। দেখা দিয়েছে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ। চরম জনরোষের মুখে শনিবার বাসভবন ছেড়ে পালিয়েছেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে। কদিন আগেই ক্ষমতা নেওয়া প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেও পদ ছাড়তে চান। সব মিলিয়ে এখন চরম অর্থনৈতিক–রাজনৈতিক সংকটে দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশ।

তবে একসময়ের উচ্চ–মধ্যম আয়ের দেশ শ্রীলঙ্কায় এ সংকট হঠাৎ দেখা দেয়নি। দেশটির আয়ের অন্যতম মাধ্যম পর্যটন ও বিদেশে থাকা শ্রীলঙ্কানদের পাঠানো অর্থ। কিন্তু করোনা মহামারিতে পর্যটন খাতের ধাক্কা দেশটির আয় কমিয়েছে। বিদেশে অবস্থানরত শ্রীলঙ্কানরাও কম অর্থ দেশে পাঠিয়েছেন। এতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে যায়। যা খাবার, ওষুধ ও জ্বালানির মতো নিত্যপণ্য আমদানি বাধাগ্রস্ত করে। বাড়তে থাকে জিনিসপত্রের দাম।

টানা কয়েক মাস ধরে বিদ্যুৎ–সংকটে রাজধানী কলম্বোসহ শ্রীলঙ্কার বেশির ভাগ এলাকা অন্ধকারে ডুবে ছিল। কাগজ না থাকায় বন্ধ হয়ে যায় পত্রিকার ছাপা সংস্করণ। স্কুল–কলেজ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় সরকার। খাবারের দোকান, পেট্রলপাম্পের সামনে দেশটির সাধারণ মানুষের লাইন লম্বা থেকে আরও লম্বা হয়েছে। জনগণ দায়ী করে সরকারের নীতিগত অব্যবস্থাপনাকে। আর নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করা শ্রীলঙ্কার সরকার পরিস্থিতি মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সহায়তা কামনা করে। কিন্তু পরিস্থিতি বদলায়নি। বরং আরও জটিল হয়েছে।

যা যা ঘটল

১ এপ্রিল: জরুরি অবস্থা জারি

জনরোষের মুখে গত ১ এপ্রিল শ্রীলঙ্কা সরকার দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করে। নিরাপত্তা বাহিনীকে যেকোনো সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়।

৩ এপ্রিল: মন্ত্রিসভার পদত্যাগ

রাতভর দীর্ঘ বৈঠকের পর তখনকার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষের সরকারের মন্ত্রীরা পদত্যাগ করেন। এতে প্রভাবশালী দুই ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে ও প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষ আরও কোণঠাসা হয়ে পড়েন। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে ঋণসহায়তা চান। পরদিন তিনিও পদত্যাগ করেন।

৫ এপ্রিল: সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারান প্রেসিডেন্ট

ক্ষমতা নেওয়ার এক দিনের মাথায় পদ ছাড়েন অর্থমন্ত্রী আলি সাবরি। ক্ষমতাসীন জোট থেকে শরিকেরা সমর্থন তুলে নেওয়ায় পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায় প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার দল। দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়া হয়।

শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে
ছবি: রয়টার্স

১০ এপ্রিল: সংকটে স্বাস্থ্য খাত

শ্রীলঙ্কার চিকিৎসকেরা জানান, তাঁদের হাতে প্রয়োজনীয় ওষুধের মজুত নেই। সতর্ক করে তাঁরা বলেন, এভাবে চলতে থাকলে করোনা মহামারির চেয়ে ওষুধসংকটে বেশি মানুষের মৃত্যু হতে পারে।

১২ এপ্রিল: ঋণখেলাপি ঘোষণা

শ্রীলঙ্কা সরকার জানিয়ে দেয়, ৫১ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা তাদের নেই। একই সঙ্গে ওষুধসহ প্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য দেশটির জরুরিভিত্তিতে বিদেশি সহায়তা প্রয়োজন।

১৯ এপ্রিল: বিক্ষোভে প্রথম প্রাণহানি

কয়েক সপ্তাহ ধরে চলমান সরকারবিরোধী বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে প্রথম একজন নিহত হন।

টানা কয়েক মাস ধরে বিদ্যুৎ–সংকটে রাজধানী কলম্বোসহ শ্রীলঙ্কার বেশির ভাগ এলাকা অন্ধকারে ডুবে ছিল। কাগজ না থাকায় বন্ধ হয়ে যায় পত্রিকার ছাপা সংস্করণ। স্কুল–কলেজ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় সরকার। খাবারের দোকান, পেট্রলপাম্পের সামনে দেশটির সাধারণ মানুষের লাইন লম্বা থেকে আরও লম্বা হয়েছে।
আরও পড়ুন

৯ মে: সহিংস একটি দিন

রাজধানী কলম্বোয় প্রেসিডেন্ট ভবনের সামনে সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সরকারপন্থীদের সংঘর্ষ হয়। নিহত হন ৯ জন। আহত হন শতাধিক। দেশজুড়ে আইনপ্রণেতা ও সরকারি কর্তাব্যক্তিদের বাড়িতে বাড়িতে হামলা হয়। জনরোষের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে। ক্ষমতায় আসেন কয়েকবারের প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে।

১০ মে: গুলি চালানোর অনুমতি

সরকারে পালাবদলের পরও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। কমেনি বিক্ষোভ। এদিন শ্রীলঙ্কার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য নিরাপত্তা বাহিনীকে বিক্ষোভ ও লুটপাটে অংশ নেওয়া যে কাউকে প্রয়োজনে গুলি চালানোর অনুমতি দেয়। তবে কারফিউ উপেক্ষা করে চলে বিক্ষোভ।

আরও পড়ুন

১০ জুন: মানবিক সংকটের ঝুঁকি

জাতিসংঘ জানায়, চরম মানবিক সংকটের মুখে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। খাদ্যসংকটের মুখে দেশটির কয়েক লাখ মানুষের জরুরি সহায়তা প্রয়োজন।

২৭ জুন: জ্বালানি বিক্রি বন্ধ

শ্রীলঙ্কা সরকার জানায়, প্রয়োজন অনুযায়ী জ্বালানি তাদের হাতে নেই; যা মজুত আছে, তা দিয়ে অল্প কয়েক দিন চালানো সম্ভব হবে। এ কারণে পেট্রলসহ জ্বালানি বিক্রি বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন

১ জুলাই: রেকর্ড মূল্যস্ফীতি

দেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ে তথ্য প্রকাশ করে শ্রীলঙ্কা সরকার। দেখা যায়, টানা ৯ মাস ধরে বাড়তে থাকা মূল্যস্ফীতি রেকর্ড ছাড়িয়েছে।

৯ জুলাই: প্রেসিডেন্টের পলায়ন

আগের দিনের মতো কলম্বোয় তুমুল বিক্ষোভ হয়। ছাত্র–জনতার রোষের মুখে বাসভবন ছেড়ে পালান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া। বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্ট ভবনে ঢুকে পড়েন। পদ ছাড়ার ইচ্ছার কথা জানান প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে।

আরও পড়ুন