মুসলিমপ্রধান অনেক দেশই এখন অবধি ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেনি। ফিলিস্তিনিদের প্রতি বছরের পর বছর ধরে ইসরায়েলের দমন–পীড়নের অপরাধের প্রতিবাদেই মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর এমন সিদ্ধান্ত। অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে অনেক দেশই কূটনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ে নানা পূর্ব ধারণা ও সিদ্ধান্ত থেকে বেরিয়ে আসছে। অনেক ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক সম্পর্কই কূটনৈতিক সম্পর্কের গতিপথ ঠিক করে দিচ্ছে। আবার স্বীকৃতি বা আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক না থাকার পরেও ভেতরে-ভেতরে নানা ধরনের সম্পর্ক ও বিনিময়কে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
তুরস্ক ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল সেই ১৯৪৯ সালে, ইসরায়েলের স্বাধীনতা ঘোষণার এক বছর পরে। একই সঙ্গে তা ছিল কোনো ইহুদি রাষ্ট্রকে কোনো মুসলিমপ্রধান দেশের প্রথম স্বীকৃতি। তুরস্কের ওই সিদ্ধান্ত বেশির ভাগ মুসলিম রাষ্ট্রের কল্পনারও অতীত ছিল।
কারণ, ফিলিস্তিন ভূখণ্ড বিভক্ত করে ইহুদি ও ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর জন্য দুটি আলাদা রাষ্ট্র সৃষ্টির বিষয়ে জাতিসংঘের আনা প্রস্তাবের বিপক্ষেই ছিল তুরস্ক। স্বীকৃতির পর ১৯৫০ সালের ৭ জানুয়ারি ইসরায়েলের তেলআবিব শহরে প্রথম কূটনৈতিক মিশন স্থাপন করে তুরস্ক। প্রসঙ্গত, ইসরায়েলকে প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তুরস্ক যদি হয় বুনো ওল, ইসরায়েল তবে বাঘা তেঁতুল। ইসরায়েল আয়তনে ছোট্ট একটি দেশ হতে পারে, কিন্তু শক্তিতে, উদ্ভাবনে, কৌশলে খুবই প্রভাব বিস্তারকারী। অপর দিকে অটোমান সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার তুরস্কও শিল্পে, কৃষিতে ও সামরিক শক্তিতে শক্তিশালী একটি দেশ, যারা একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তুরস্ক যদি হয় বুনো ওল, ইসরায়েল তবে বাঘা তেঁতুল। ইসরায়েল আয়তনে ছোট্ট একটি দেশ হতে পারে, কিন্তু শক্তিতে, উদ্ভাবনে, কৌশলে খুবই প্রভাব বিস্তারকারী। অপর দিকে অটোমান সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার তুরস্কও শিল্পে, কৃষিতে ও সামরিক শক্তিতে শক্তিশালী একটি দেশ, যারা একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলে।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশ দুটির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কাছে আসা ইঙ্গিত দেয় যে তেলআবিব ও আঙ্কারা পারস্পরিক স্বার্থে কূটনৈতিক সম্পর্ক এগিয়ে নিতে আগ্রহী।
মে মাসের শেষ সপ্তাহে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু, জ্বালানিমন্ত্রী ফেইথ দনমেজ ইসরায়েল সফর করেন। এটা ছিল গত প্রায় দেড় দশকের মধ্যে তুরস্কের উচ্চপদস্থ কোনো প্রতিনিধিদলের ইসরায়েল সফর। ওই সফরে দুই দেশের মধ্যে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ এবং জ্বালানি খাতে কৌশলগত সহযোগিতার মতো বিষয়গুলো নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়।
ইতিহাসের পথ ধরে
ইসরায়েল নামে যে ভূখণ্ডটি, সেটি একসময় অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনেই ছিল। ১৫১৭ থেকে ১৯১৭—চার শ বছর তারা শাসন করে। ১৯১৭ সালে জায়গাটি ব্রিটিশদের দখলে আসে। আমরা যদি তুরস্ক ও ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্কের গতিপথ বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখতে পাব, তাদের সম্পর্কে সব সময় কমবেশি সন্দেহ ও অবিশ্বাস ছিল। এ কারণে সম্পর্ক স্বাভাবিক ছিল না বলা যায়, অনেকটা না থাকার মতো।
২০২১ সালের শেষের দিকে তুরস্ক ইসরায়েলি এক দম্পতিকে মুক্তি দেয়, আঙ্কারা থেকে যাদের আটক করা হয়েছিল গোয়েন্দাগিরির অভিযোগে। তাঁরা নাকি গোপনে প্রেসিডেন্টের বাড়ির ছবি তুলছিলেন। ইসরায়েলি দম্পতিকে মুক্তি দেওয়ায় খুশি হয়ে আঙ্কারা সফর করেন ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজগ।
১৯৫৬ সালে ইসরায়েল মিসরের সিনাই উপদ্বীপে আক্রমণ ও সুয়েজ খাল দখলের চেষ্টা করলে তুরস্ক সে দেশ থেকে তার কূটনীতিককে প্রত্যাহার করে নেয়। এর দুই বছর পরে তুরস্কের মান ভাঙাতে গোপনে সে দেশ সফর করেন ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেনগুরিয়ান, যাকে ইহুদি রাষ্ট্রটির জাতির পিতা বলা হয়। ওই সময়ে দেশ দুটি আবার সম্পর্ক মেরামত করে। এভাবে আসে ১৯৬৭ সাল। ওই বছর ইসরায়েল জেরুজালেমসহ আরব বিশ্বের বিরাট অঞ্চল দখল করে নেয়। তুরস্ক এ ঘটনার প্রতিবাদ জানালেও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেনি, আরব দেশগুলোর তীব্র চাপ সত্ত্বেও।
১৯৭৫ সালে তুরস্ক আনুষ্ঠানিকভাবে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনকে (পিএলও) স্বীকৃতি দেয়। ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক চলমান থাকা অবস্থাতেই ১৯৮৮ সালের ১৫ নভেম্বর ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় তুরস্ক। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রথম দিকের রাষ্ট্রগুলোর একটি তুরস্ক।
১৯৯৬ সালে ইসরায়েল ও তুরস্ক কৌশলগত সহযোগিতা বিষয়ে চুক্তি করে। ওই চুক্তির আওতায় দুই দেশের বিমানবাহিনী পরস্পরকে প্রশিক্ষণ দেয়। এরপর দুই দেশের মধ্যে অস্ত্র সহযোগিতার আরও চুক্তি হয়েছিল। এ নিয়ে তখন ইরানসহ আরব বিশ্বের দেশগুলোর সমালোচনার মুখে পড়েছিল তুরস্ক।
কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর ইসরায়েলের একাধিক প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী তুরস্ক সফর করেছেন। তেমনি তানসু সিলার, রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানসহ একাধিক প্রেসিডেন্ট ইসরায়েল সফর করেছেন। সম্পর্ক দহরম-মহরম থাকা অবস্থায় তুরস্ক সেখানে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দিয়েছে, আবার শীতল পরিস্থিতি তৈরি হলে দেওয়া হয়েছে কনস্যুলার বা চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স পদমর্যাদার কর্মকর্তা।
এভাবেই চলছিল সম্পর্ক। এটা হঠাৎ থেমে যায় ২০১০ সালে ‘মাভি মারমারা’র ঘটনার পর। ইসরায়েল তখন গাজা অবরোধ করে রেখেছে। এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে তুরস্ক থেকে কয়েক শ স্বেচ্ছাসেবী মাভি মারমারা নামে জাহাজে করে গাজার দিকে রওনা হয়।
ইসরায়েলের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ ও গাজাবাসীর প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করাই ছিল এই সফরের উদ্দেশ্য। কিন্তু পথে ইসরায়েলি নৌবাহিনী তুরস্কের ওই জাহাজে হামলা চালায়।
এতে কমপক্ষে ১০ জন তুর্কি স্বেচ্ছাসেবী নিহত হন। ওই ঘটনায় তুরস্ক ক্ষমা চাওয়ার জন্য ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানায়। কিন্তু তেলআবিব ক্ষমা চায়নি। এ অবস্থায় উভয় দেশ রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নেয়। পরে ২০১৩ সালে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এ ঘটনার জন্য ক্ষমা চান এবং দুই কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দেন। বলা হয়ে থাকে, ক্ষমা চাওয়ার জন্য তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ভূমিকা রেখেছিলেন। এতে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আবার স্বাভাবিক অবস্থায় পৌঁছায়।
কিন্তু এক বছর না যেতেই ফিলিস্তিনের গাজায় তীব্র হামলা করে ইসরায়েল। তুরস্ক যেহেতু ফিলিস্তিনিদের অধিকার রক্ষার প্রতি সহানুভূতিশীল, তাই ওই ঘটনা আবার আঙ্কারা ও তেলআবিবের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে। ২০১৫ সালে দেশ দুটি আবার সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। ইসরায়েল তুরস্কে একজন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেয়, কিন্তু ফিলিস্তিনি ইস্যুর কথা চিন্তা করে তুরস্ক সেখানে কূটনীতিক নিয়োগ দিতে ইতস্ততবোধ করে।
এর মধ্যে ২০১৮ সালে পূর্ব জেরুজালেমে নতুন মার্কিন দূতাবাস চালু করা হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে গাজায় প্রচণ্ড বিক্ষোভ করেন ফিলিস্তিনিরা। ইসরায়েলে নিরাপত্তা বাহিনী গাজাবাসীর প্রতি নির্বিচার দমন–পীড়ন চালায়। ইসরায়েলের এমন আচরণের প্রতিবাদ জানিয়ে তুরস্ক তার দেশ থেকে ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করে।
ইসরায়েলও বসে থাকেনি। তৎক্ষণাৎ তারাও তেলআবিব থেকে তুরস্কের কনসাল জেনারেলকে বাড়ি ফেরার চিঠি ধরিয়ে দেয়।
তুরস্ক ও ইসরায়েল একে অপরের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে অবগত। যেমন ইরাকের উত্তরাঞ্চলে সক্রিয় কুর্দি গোষ্ঠীগুলো ইসরায়েলের কাছ থেকে সহায়তা পায়। এই কুর্দিরা তুরস্কের বিরুদ্ধে নানা তৎপরতায় লিপ্ত। তেমনি ফিলিস্তিনের জাতীয়তাবাদী হামাস গোষ্ঠীকে সহায়তা দেয় তুরস্ক, যে হামাস ইসরায়েলের অস্তিত্বকে স্বীকার করতে চায় না।
অতীতের তিক্ততা ভুলে দুটি দেশ এখন আবার কাছাকাছি এসে একটি সম্পর্কের মহাসড়কে ওঠার চেষ্টা করছে। বিশেষ করে গত দুই বছর তাদের মধ্যে ইতিবাচক নানা কিছু ঘটেছে। ২০২১ সালের শেষের দিকে তুরস্ক ইসরায়েলি এক দম্পতিকে মুক্তি দেয়, আঙ্কারা থেকে যাঁদের আটক করা হয়েছিল গোয়েন্দাগিরির অভিযোগে। তাঁরা নাকি গোপনে প্রেসিডেন্টের বাড়ির ছবি তুলছিলেন। ইসরায়েলি দম্পতিকে মুক্তি দেওয়ায় খুশি হয়ে আঙ্কারা সফর করেন ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজগ। সেখানে তিনি উষ্ণ অভ্যর্থনায় সিক্ত হন।
কেন এই সম্পর্ক জোরদারের চেষ্টা
ইসরায়েলে নাফতালি বেনেটের জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরে সরকারের কোনো কোনো অংশীদার চেয়েছে তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্কে গতি আনতে, যে জোটে একটি আরব দলও রয়েছে। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরকারের সময় এ ধরনের আহ্বান তেমন ছিল না।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুরস্কও তাঁর কিছু প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা জোরদার করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিদায় ও জো বাইডেনের ক্ষমতায় আসা, ইরানের আঞ্চলিক তৎপরতা, সিরিয়ায় পতনের মুখ থেকে আসাদ সরকারের ফিরে আসা ও সেখানে স্থিতিশীলতা—এসব আন্তর্জাতিক ঘটনার প্রেক্ষাপটেই তুরস্কের কূটনৈতিক দিগন্ত বাড়ানোর এমন প্রচেষ্টা।
বিষয়টি যদি ব্যাখ্যা করে বলা হয়, তবে এটা বলতে হবে যে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট হয়ে এসে জো বাইডেন মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা ও শৃঙ্খলার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি যেমন পূর্ব জেরুজালেমে যুক্তরাষ্ট্রের কনস্যুলেট খোলার কথা বলেছেন, তেমনি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে অর্থনৈতিক ও মানবিক সহায়তা দেওয়ার কথাও জোর দিয়ে বলছেন, ট্রাম্পের আমলে যা স্থগিত ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এ বিষয়ে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন। প্রকৃতপক্ষে বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতির আগ্রহ ও প্রতিযোগিতা মূলত সি চিন পিংয়ের চীনের সঙ্গে, আর কিছুটা পুতিনের রাশিয়ার সঙ্গে। ফিলিস্তিনি, ইসরায়েল বা মধ্যপ্রাচ্যের দিকে ততটা নয়।
আর ইরানের পরমাণু সামর্থ্য দিন দিন বৃদ্ধিও ওই অঞ্চলে তেহরানবিরোধী দেশগুলোকে এক পাল্লায় উঠে বসতে উৎসাহ জুগিয়েছে। শেষ পর্যন্ত সিরিয়ায় আসাদ সরকারের টিকে যাওয়া এবং সে দেশে ইরানের প্রভাব বৃদ্ধিও ওই অঞ্চলে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এসব কারণে সেখানকার দেশগুলো কূটনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টি পর্যালোচনা করছে এবং আগের পূর্ব ধারণা থেকে বেরিয়ে আসছে। সেই জায়গা থেকেও তুরস্ক ও ইসরায়েলের সম্পর্ক জোরদারের চেষ্টা বলে কোনো কোনো বিশ্লেষকের অভিমত।
কেবল ইসরায়েল নয়, মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও সৌদি আরবের সঙ্গেও সম্পর্ক জোরদারের পদক্ষেপ নিচ্ছে তুরস্ক। কারণ, দেশটি সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে রয়েছে।
কার কতটা লাভ
কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাণিজ্য, গোয়েন্দা, জ্বালানি এবং প্রতিরক্ষা—এই চারটি খাতে দেশ দুটি একে অপরের মধ্যে সহযোগিতা বাড়াতে পারে। তবে যতই রাজনৈতিক উত্তেজনা ও টানাপোড়েন থাকুক, দেশ দুটির মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক কিন্তু বেড়েই চলেছে। ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টারের তথ্যমতে, ২০১৮ সালে ইসরায়েল ও তুরস্কের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ছয় বিলিয়ন ডলার।
ইসরায়েলের প্রাকৃতিক গ্যাস ইউরোপে সরবরাহের জন্য তুরস্ক ও ইসরায়েল একসঙ্গে কাজ করতে পারে। এ ছাড়া বিদ্যুৎক্ষেত্রে সহযোগিতা নিয়েও আলোচনা চলছে তাদের মধ্যে। তুরস্কের বেশির ভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। দেশটি শক্তিশালী সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য। ভূরাজনৈতিক দিক থেকেও দেশটির শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে। ইসরায়েলের কাছে তুরস্কের এই বিষয়গুলো তার জন্য ইতিবাচক হতে পারে। যদি তুরস্কের সঙ্গে তাদের একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি হয়, তাহলে অন্যান্য মুসলিম দেশ ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সঙ্গে তাদের স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরির পথ খুলে যাবে। এখন পর্যন্ত পাকিস্তান, আলজেরিয়া, ইরাক, কুয়েত, লেবানন, লিবিয়া, মরক্কো, ওমান, কাতার, সৌদি আরব, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, মালয়েশিয়াসহ বেশ কটি মুসলিমপ্রধান দেশ ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়নি।
অপর দিকে ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসিতে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, তুরস্কের জাতীয়তাবাদী নেতা এরদোয়ান ভাবছেন, মার্কিন কংগ্রেসে তার দেশ সম্পর্কে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরিতে ইসরায়েল সহায়তা করতে পারে। ইসরায়েলের সে সামর্থ্য আছে। ইসরায়েল কিছুটা তা করেছেও।
দুটি দেশই একে অপরের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে অবগত। যেমন ইরাকের উত্তরাঞ্চলে সক্রিয় কুর্দি গোষ্ঠীগুলো ইসরায়েলের কাছ থেকে সহায়তা পায়। এই কুর্দিরা তুরস্কের বিরুদ্ধে নানা তৎপরতায় লিপ্ত। তেমনি ফিলিস্তিনের জাতীয়তাবাদী হামাস গোষ্ঠীকে সহায়তা দেয় তুরস্ক, যে হামাস ইসরায়েলের অস্তিত্বকে স্বীকার করতে চায় না। সম্প্রতি তুরস্ক তার দেশে হামাসের তৎপরতাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। তার মানে এই নয় যে তুরস্ক ও হামাসের মধ্যে সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে। এ বিষয়গুলো মাথায় রেখেই সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টায় রয়েছে দেশ দুটি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকলে ফিলিস্তিনি ইস্যুতে সরাসরি ইসরায়েলবিরোধী অবস্থান না নিয়ে তুরস্ক মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিতে পারে। যদিও তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু গত বছর বলেছেন, ইসরায়েল ও তুরস্কের সম্পর্ক কেমন হবে, তা অনেকটা নির্ভর করছে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে বেআইনি আচরণ বন্ধ করবে কি না, তার ওপর।
সত্যিকার অর্থে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে সুবিধা নিতে হলে দুটি দেশকেই সমান আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। বের করতে হবে অভিন্ন স্বার্থ ও অবস্থানের জায়গাগুলো। আগামী দিনগুলোতে দেশ দুটি কীভাবে সম্পর্ককে এগিয়ে নেয়, সেদিকে নজর থাকবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে আগ্রহী পর্যবেক্ষকদের।
(তথ্যসূত্র: ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসি, বিবিসি, এশিয়া টাইমসসহ বিভিন্ন বার্তা সংস্থা ও সাময়িকী অবলম্বনে)
• কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক
ই-মেইল: [email protected]