কাশ্মীর নিয়ে কেন ভারতের সঙ্গে পেরে উঠছে না পাকিস্তান

কাশ্মীর সংকট নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের সমস্যা চিরচেনাফাইল ছবি: রয়টার্স

কাশ্মীর সংকট নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের সমস্যা চিরচেনা। ভারত ও পাকিস্তান আলাদা দেশ হওয়ার পর কাশ্মীরও দুই ভাগ হয়ে যায়। ভারত ও পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে যাওয়া কাশ্মীরের দুই অংশে আসে আলাদা শাসননীতি। তবে কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতে বিপক্ষে পাকিস্তান দিন দিন কোণঠাসা হয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন দেশটির সাবেক এক কূটনীতিক। এ ইস্যুতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পাকিস্তান সমর্থন হারিয়েছে বলে মনে করছেন তিনি। খবর ডনের।

কাশ্মীর–নীতিতে পাকিস্তানের অবস্থান আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বাজে বলে আখ্যায়িত করছেন পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত জাভিদ হুসাইন। বর্তমানের তিনি লাহোর কাউন্সিল ফর ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্সের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের জন্মের প্রথম দিকে, গত শতকের চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে কাশ্মীর নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে পাশে পাওয়া যেত। তবে দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তা কঠিন হয়ে পড়েছে।

২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ভারত তাদের কাশ্মীর–নীতিতে বড় পরিবর্তন আনে। ভারতনিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে দ্বিখণ্ডিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রাজ্যটিকে দ্বিখণ্ডিত করে ‘জম্মু ও কাশ্মীর’ এবং ‘লাদাখ’ নামে দুটি আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করা হয়। ভারতের এ পদক্ষেপে বিপক্ষে সরব হয় পাকিস্তান। তবে বিষয়টিকে একপ্রকার এড়িয়ে যায় নিরাপত্তা পরিষদ। পাকিস্তানের অভিযোগ বিবেচনায় এনে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বৈঠকও করেনি তারা।

ভারত–পাকিস্তান সীমান্তে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কুচকাওয়াজ
ফাইল ছবি: রয়টার্স

জাভিদ হুসাইন মনে করেন, কাশ্মীরে ভারতের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বড় অভিযোগ থাকার পরও তারা বিশ্ব সম্প্রদায়ের সমর্থন পেয়ে যাচ্ছে। এর প্রমাণ হচ্ছে সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে ভারতের নির্বাচন। সেখানে জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলোর বেশির ভাগের সমর্থন পায় তারা। শুধু জাতিসংঘই নয়, মুসলিম দেশগুলোর জোট ওআইসিতেও কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তান পায়ের নিচের মাটি হারাচ্ছে। কারণ, ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে ভারতের পদক্ষেপের পর এ নিয়ে জোটের দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের একটি বৈঠকের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতকে মোকাবিলা করতে পাকিস্তানকে আরও শক্তিশালী হতে হবে বলে মনে করছেন জাভিদ হুসাইন। তবে আদতে কিন্তু তেমনটি ঘটছে না। সময়ের সঙ্গে প্রতিবেশী দুই দেশের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি ভারসাম্য হারিয়েছে। দুই ক্ষেত্রেই ভারতের চেয়ে বেশ পিছিয়ে রয়েছে পাকিস্তান। খাতা–কলমের হিসাবে, এই মুহূর্তে ভারতের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৩ দশমিক শূন্য ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, সেখানে পাকিস্তানের জিডিপি মাত্র ২৮৬ বিলিয়ন ডলার।

সাবেক এই রাষ্ট্রদূতের ভাষ্য, কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের নৈতিক ও আইনি যুক্তিগুলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমলে নিচ্ছে না। পাশাপাশি ভারত ও কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের কৌশলগত লক্ষ্য ও নীতির স্পষ্টতা ও ধারাবাহিকতার অভাবও রয়েছে। এগুলো ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের অবস্থান আরও নড়বড়ে করে তুলছে।

এর মধ্যে আবার মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের চলমান দ্বন্দ্ব। চীনের সঙ্গেও ভারতের সাংঘর্ষিক সম্পর্ক রয়েছে। এর জের ধরে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সখ্য বাড়ছে। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে আবার গভীর হয়েছে চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক। এই ভাঙাগড়ার কারণে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্পর্কের হিসাব–নিকাশ বদলে যাচ্ছে। এর জের ধরে পাকিস্তানকে কৌশলগত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে বলে মনে করছেন জাভিদ হুসাইন।

আফগানিস্তানে ক্ষমতার মসনদে তালেবান বসা পাকিস্তানের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন জাভিদ হুসাইন। এ ছাড়া ভারতে হিন্দুত্ববাদের ক্রমবর্ধমান উত্থান পাকিস্তানের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ভবিষ্যতে এ পরিস্থিতি বা কাশ্মীর নিয়ে ভারতের অবস্থান পাকিস্তানের পক্ষে আসবে না বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত জাভিদ হুসাইন। বর্তমানের তিনি লাহোর কাউন্সিল ফর ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্সের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন
ফাইল ছবি: টুইটার থেকে সংগৃহীত

কাশ্মীর পরিস্থিতির কারণ হিসেবে এর ভৌগোলিক অবস্থানও দায়ী—এমনটাই ভাষ্য জাভিদ হুসাইনের। তিনি বলেন, কাশ্মীরের অবস্থান এমন জায়গায়, যাকে ঘিরে হিন্দু ও মুসলিম সভ্যতাগুলো গড়ে উঠেছে। ফিলিস্তিনের ব্যাপারটাও একই। এসব সমস্যার সমাধান করতে কয়েক দশক থেকে শতক সময় লাগতে পারে। কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে তাই পাকিস্তানকে স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপের চেয়ে ক্ষমতাকেন্দ্রিক দীর্ঘমেয়াদি কৌশল গ্রহণ করতে হবে।

কেমন হতে পারে এ দীর্ঘমেয়াদি কৌশল? তারও আভাস দিয়েছেন জাভিদ হুসাইন। তিনি বলেন, ভারতের চেয়ে পাকিস্তানকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক দিকগুলো দ্রুত শক্তিশালী করে তুলতে হবে। এসবের পাশাপাশি কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের জন্য একটি সক্রিয় পররাষ্ট্রনীতির প্রয়োজন। পাকিস্তানে বড় একটি সমস্যা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। স্থিতিশীলতা আনতে গণতান্ত্রিক রীতিনীতিগুলোকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। এ ছাড়া অতীতের পথ না মাড়িয়ে পাকিস্তানের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবশ্যই সংবিধান মেনে কাজ করতে হবে।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপর জোর দিয়ে জাভিদ হুসাইন বলেন, পাকিস্তানে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়াতে, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতিগুলো সবার সামনে তুলে ধরতে এবং স্বনির্ভরতার নীতি বাস্তবায়ন করতে সুদূরপ্রসারী কাঠামোগত সংস্কার আনতে হবে। সবকিছু করতে হবে নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখেই। এর ব্যতিক্রম হলে কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতের চেয়ে পাকিস্তান আরও পিছিয়ে পড়বে।