আফগানিস্তান পরিস্থিতি
কাবুল দখল, প্রেসিডেন্টের দেশত্যাগ
তালেবানের নিয়ন্ত্রণে আফগানিস্তান। রাজধানী কাবুলে তালেবান যোদ্ধাদের প্রবেশের পর আতঙ্কিত জনপদে পরিণত হয়েছে পুরো নগরী।
আফগানিস্তানে তালেবানের হাতে প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির সরকারের পতন নিশ্চিত হয়ে গেছে। গতকাল রোববার তালেবান যোদ্ধারা রাজধানী কাবুলে প্রবেশের পর দেশ ছেড়েছেন আশরাফ গনি। দেশটির প্রেসিডেনশিয়াল প্যালেসের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার দাবি করেছে তালেবান বাহিনী।
এর আগেই রাজধানীর চারপাশ ঘিরে ফেলে তালেবান বাহিনী। এ পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী একটি সরকারের হাতে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের আলোচনাও শুরু হয়েছে।
তালেবানের পক্ষ থেকেও শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলা হয়েছে। তবে তালেবান যোদ্ধাদের আগমনে আতঙ্কের নগরীতে পরিণত হয়েছে কাবুল। সেখান থেকে দূতাবাসকর্মীদের সরিয়ে নিতে শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা।
প্রেসিডেনশিয়াল প্যালেস দখলের দাবি
তালেবানের দুজন জ্যেষ্ঠ কমান্ডার দাবি করেছেন, কাবুলে প্রেসিডেনশিয়াল প্যালেস দখল করেছেন তাঁরা। কাবুলে অবস্থানরত ওই দুজন কমান্ডার গতকাল বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, এ প্যালেস এখন পুরোপুরি তালেবানের নিয়ন্ত্রণে। যদিও সরকারি কোনো সূত্র থেকে এ দাবির সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এদিকে প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি গতকালই কাবুল ছেড়ে তাজিকিস্তানের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে রয়টার্স এ কথা জানিয়েছে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, আশরাফ গনি ফেসবুক পোস্টে বলেছেন, কাবুলে রক্তপাত এড়াতে তিনি দেশ ছেড়েছেন।
এ বিষয়ে আফগান প্রেসিডেন্ট দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বলা হয়, নিরাপত্তার খাতিরে তাঁরা প্রেসিডেন্ট কী করছেন বা কোথায় আছেন, সে বিষয়ে কিছু বলতে চান না।
আশরাফ গনিকে আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেবে উল্লেখ করেছেন আফগান শান্তিপ্রক্রিয়ার অন্যতম আলোচক হাই কাউন্সিল ফর ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশনের চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আবদুল্লাহ। নিজের ফেসবুক পেজে এক ভিডিও পোস্টে তিনি বলেন, ‘আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট দেশ ছেড়েছেন...তিনি জাতিকে ফেলে গেছেন। সৃষ্টিকর্তা তাঁকে জবাবদিহি করবেন।’
‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের’ আলোচনা
সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, আফগান সরকার একটি ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের’ হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে বলে শোনা যাচ্ছে। সে বিষয়ে তালেবান ও সরকারের মধ্যে আলোচনাও শুরু হয়েছে। রয়টার্সের খবরে বলা হয়, এ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দেশটির সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও কূটনীতিক আলী আহমাদ জালালির নাম শোনা যাচ্ছে।
তালেবানের মুখপাত্র সুহাইল শাহিন গতকাল ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে বলেছেন, কয়েক দিনের মধ্যেই শান্তিপূর্ণভাবে এ ক্ষমতা হস্তান্তর হবে বলে তাঁরা আশা করছেন। কাবুলের জনগণের জানমাল নিরাপদ থাকবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। নারী অধিকার রক্ষার পাশাপাশি গণমাধ্যমকর্মী ও কূটনীতিকদের স্বাধীনতাও নিশ্চিত করার কথা বলেছেন তালেবান মুখপাত্র।
তবে তালেবানের এমন কথায় ভরসা করতে পারছে না কাবুলের জনগণ। দেশ ছাড়তে বিমানবন্দরে ভিড় করছেন হাজারো মানুষ।
তালেবান বাহিনী দেশটির অধিকাংশ প্রাদেশিক রাজধানী দখলে নেওয়ার পর গত শনিবার রাতে দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় শহর মাজার-ই-শরিফ দখলে নেয়। এরপর আফগান সরকারের নিয়ন্ত্রণে মাত্র দুটি গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল—রাজধানী কাবুল ও জালালাবাদ। গতকাল সকালে যুদ্ধ ছাড়াই কাবুল থেকে ৮০ মাইল দূরের জালালাবাদের নিয়ন্ত্রণ নেয় তালেবান। এরপর রাজধানীর দিকে এগোতে থাকেন তালেবান যোদ্ধারা। চারদিক থেকে কাবুল ঘিরে ফেলেন তাঁরা। একপর্যায়ে রাজধানীতে ঢুকে পড়েন তাঁরা।
কাবুল বিমানবন্দরে গোলাগুলি
কাবুল বিমানবন্দরে গোলাগুলির খবর পাওয়া গেছে। মার্কিন দূতাবাসের সূত্রের বরাত দিয়ে এ কথা জানিয়েছে বিবিসি। ওই এলাকায় অবস্থানরত মার্কিনদের নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে দূতাবাসের পক্ষ থেকে। দূতাবাসের কর্মকর্তারা বলছেন, কাবুলের নিরাপত্তা পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হচ্ছে। মার্কিনদের সহায়তা পেতে অনলাইনে নিবন্ধনের আহ্বান জানানো হয়েছে।
এদিকে কাবুলের একটি হাসপাতালে বেশ কয়েকজন আহত ব্যক্তিকে নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় একটি বেসরকারি সংস্থার বরাত দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে, ৪০ জনের বেশি ব্যক্তিকে এ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
আতঙ্কে সাধারণ মানুষ
কাবুল থেকে বিবিসির একজন সাংবাদিক গতকাল জানান, অধিকাংশ মার্কেট ও দোকানপাট বন্ধ। কেউ কেউ বলছেন, তাঁরা এত বেশি আতঙ্কিত আগে কখনো হননি। অনেক সরকারি দপ্তরও বন্ধ রয়েছে। অনেক সেনা ও পুলিশ সদস্য তল্লাশিচৌকি ফেলে পালিয়ে যাচ্ছেন। কিছু কিছু জায়গা থেকে গুলির শব্দ আসছে। তবে গোলাগুলির কারণ জানা যায়নি।
তালেবান কাবুল দখল করেছে বলে অনলাইনে গুজব ছড়ালে আতঙ্ক আরও বাড়ে। কাবুল থেকে পালাতে শুরু করে মানুষ। যে যার মতো করে শহর ছাড়ার চেষ্টা করায় সড়কে গাড়ির দীর্ঘ জট তৈরি হয়। এদিকে বাসিন্দাদের অনেকে টাকা তোলার জন্য ব্যাংকে ভিড় করেন। পরিস্থিতির বর্ণনায় আফগান এমপি ফারজানা কোচাই বিবিসিকে বলেন, ‘আমি নিজের ঘরেই আছি। দেখছি মানুষ কীভাবে পালানোর চেষ্টা করছে। আমি জানি না তারা কোথায় যাওয়ার চেষ্টা করছে। এটা হৃদয়বিদারক!’
আফগানিস্তানের সঙ্গে তোরখাম সীমান্ত আগেই বন্ধ করে দিয়েছে পাকিস্তান। এর ফলে শুধু কাবুল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়েই দেশটি ছাড়ার সুযোগ রয়েছে। একজন বাসিন্দা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, অনেকে গাড়িতে চাবি ফেলে হেঁটে বিমানবন্দরের পথ ধরছেন। বিবিসি প্রতিনিধি সেকুন্ডার কেরমানি বলেছেন, মানুষ আতঙ্কিত। তাদের আতঙ্ক পরিবারের সদস্য, বিশেষ করে স্ত্রী ও মেয়েদের নিয়ে।
মানবিক বিপর্যয়ের শঙ্কা
আফগানিস্তানে মানবিক বিপর্যয় ঘটতে পারে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ। সহিংসতার মধ্যে আফগানিস্তানের বিভিন্ন এলাকা থেকে পালিয়ে আসা লোকজন কাবুলের বিভিন্ন পার্ক ও অস্থায়ী ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। জাওজান প্রদেশ থেকে আসা একজন এএফপিকে বলেন, এক সপ্তাহ আগে তাঁরা এসেছেন। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে তাঁরা কোনো সহযোগিতা পাননি। পার্কের মধ্যে মাথা গোঁজার কোনো আশ্রয় নেই, খাবার নেই, পানি নেই।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, আফগানিস্তান থেকে যেসব খবর আসছে, তা ভয়ানক ও হৃদয়বিদারক। গত শনিবার জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর বলেছে, মে মাসের শেষ দিক থেকে এখন পর্যন্ত যে আড়াই লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, তাদের প্রায় ৮০ শতাংশই নারী ও শিশু।
কী বলছে যুক্তরাষ্ট্র
কাবুল দখল ও আফগান প্রেসিডেন্টের দেশত্যাগের খবরের পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন স্বীকার করেন, তালেবানের দেশ দখল তাদের ধারণার চেয়ে দ্রুত হয়েছে। তারপরও আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের পক্ষে কথা বলেন তিনি। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে ব্লিঙ্কেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সেনা রেখে আফগানিস্তানের স্বাভাবিক পরিস্থিতি নিশ্চিত করার ভাবনা ঠিক নয়। এখন আমেরিকার সব নাগরিককে নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনার ওপরই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ উদ্ধার কার্যক্রমে তালেবান কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করলে চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সতর্ক করেছেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, মধ্য সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব সেনা প্রত্যাহারের পরিকল্পনা থেকে সরছেন না তাঁরা। নাম প্রকাশ না করে ওই কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র শুধু তখনই পদক্ষেপ নেবে, যদি তালেবান তাদের দূতাবাসকর্মীদের বাধা দেয়। তাঁর এ বক্তব্য এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেনের অবস্থানকেই সমর্থন করছে। গত সপ্তাহে যখন তালেবান দ্রুতগতিতে এগোচ্ছিল, তখনো বাইডেন বলেছিলেন, আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার নিয়ে তাঁর কোনো অনুশোচনা নেই। তিনি বলেছিলেন, আফগানিস্তানকে যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, সেগুলো রক্ষা করা হবে। এর মধ্যে রয়েছে আফগান সেনাবাহিনীর বেতন, তাদের খাবার ও সরঞ্জাম সরবরাহ এবং বিমানসহায়তা। তবে যুদ্ধটা তাদের নিজেদের স্বার্থেই করতে হবে।
এদিকে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, আফগানিস্তান যাতে সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর না হয়, সে জন্য পশ্চিমারা সম্মিলিতভাবে কাজ করেছে। পরিস্থিতি কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। বিবিসির খবরে বলা হয়, আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাজ্যের নাগরিক এবং তাদের সহায়তাকারীদের উদ্ধারেই এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে লন্ডন। বিশ্বের অন্যান্য দেশ তড়িঘড়ি করে নতুন সরকার হিসেবে তালেবানকে স্বীকৃতি দেবে না বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে ভয়াবহ হামলার পর আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে ধরতে আফগানিস্তানে অভিযান চালায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী। এরপর দুই দশকের বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বাহিনী এবং পরে তাদের সহায়তায় গড়ে ওঠা আফগান সামরিক বাহিনীর সঙ্গে তালেবানের যুদ্ধ চলে আসছিল। গত ১ মে আমেরিকান সৈন্য প্রত্যাহার শুরু হওয়ার পর থেকে তাদের অগ্রযাত্রা শুরু হয়।