করোনাভাইরাসে নারী ও শিশুর ঝুঁকি কম?
করোনাভাইরাসে আপাতদৃষ্টিতে পুরুষের চেয়ে নারীর মৃত্যুর হার কম। অন্যদিকে, যেকোনো বয়সী আক্রান্ত মানুষের মধ্যে শিশুদের মৃত্যুঝুঁকি কম। বেশির ভাগ মানুষের মধ্য করোনাভাইরাসের মৃদু সংক্রমণের হার দেখা যাচ্ছে। তবে গুরুতর অসুস্থতার ক্ষেত্রে ভাইরাসটির প্রকৃতি একদম স্পষ্ট। চীনের রোগ নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রের বড় আকারের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বিবিসি অনলাইনের খবরে জানানো হয়, ৪৪ হাজার লোকের ওপর গবেষণা জরিপে দেখা গেছে, ২ দশমিক ৮ শতাংশ পুরুষ করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট রোগ কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। ১ দশমিক ৭ শতাংশ নারী মারা গেছে। সবচেয়ে কম শূন্য দশমিক ২ শতাংশ শিশু এবং কিশোর-কিশোরী মারা গেছে। আর সবচেয়ে বেশি মারা গেছে বয়স্ক ব্যক্তিরা। ৮০ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিদের মৃত্যুর হার ১৫ শতাংশের বেশি।
নারী ও শিশুদের কম ঝুঁকির বিষয়ে গবেষণা প্রতিবেদনে প্রাপ্ত পর্যবেক্ষণকে দুভাবে দেখা হয়েছে। হয় তারা সংক্রমণের প্রথম স্থান থেকেই কম আক্রান্ত হয়েছে অথবা তাদের দেহ এই ভাইরাসের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সক্ষম হয়েছে।
এ ব্যাপারে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব এক্সেটারের শিক্ষক ড. ভারত পানখানিয়া বলেছেন, যখন নতুন ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে, তখন স্বাভাবিকভাবে সবাই আক্রান্ত হয়, এটাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এর কারণ হচ্ছে যেহেতু কেউ এর আগে ভাইরাসটির সম্মুখীন হয়নি, তাই এর বিরুদ্ধে কারও দেহে প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। যেকোনো প্রাদুর্ভাবের শুরুতে শিশুরা খুব কমই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়।
কিংস কলেজ লন্ডনের শিক্ষক ড. নাথালি ম্যাকডেরমট বলেন, শিশুদের মধ্যে ব্যাপকভাবে তা দেখতে না পাওয়ার একটি কারণ হচ্ছে প্রাদুর্ভাবের শুরুতে তারা সুরক্ষিত থাকে, বাবা-মায়েরা শিশুদের অসুস্থ মানুষের কাছ থেকে দূরে রাখেন।
করোনাভাইরাসে নারী-পুরুষের মৃত্যুর হার কমবেশি নিয়ে সাধারণের মধ্যে বিস্ময় থাকলেও বিজ্ঞানীরা এতে অবাক নন। সাধারণ জ্বরে ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাতেও একই অবস্থা দেখা যায় বলে মনে করেন তাঁরা। এর জবাবও রয়েছে। পুরুষের জীবনে ধূমপানের মতো কিছু বাজে অভ্যাস রয়েছে। যে কারণে স্বাভাবিকভাবে পুরুষের স্বাস্থ্য নারীর চেয়ে খারাপ থাকে।
এ ব্যাপারে ড. ম্যাকডেরমট বলেন, ‘ধূমপান আপনার ফুসফুসের বারোটা বাজায়, এ অবস্থা আপনাকে জয়ী বানাতে পারে না।’
চীনে এই সমস্যাটাই প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। সেখানে ৫২ শতাংশ পুরুষ ধূমপান করে। আর নারীদের মধ্যে ধূমপানের হার মাত্র ৩ শতাংশ। এর বাইরেও যেকোনো সংক্রমণের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় পার্থক্য রয়েছে।
ইউনিভার্সিটি অব ইস্ট অ্যানগ্লিয়ার অধ্যাপক পল হান্টারের ভাষায়, যেকোনো সংক্রমণের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সাড়া দেওয়ার তরিকা আলাদা। নারীরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলা রোগে বেশি আক্রান্ত হয় এবং এর ভালো দিক হলো নারীদের দেহে জ্বরের বিরুদ্ধে ভালো অ্যান্টিবডি তৈরি হয়।
অন্তঃসত্ত্বা নারীদের কোনো ঝুঁকি আছে কি না, সে প্রশ্নও এসেছে। তথ্য–উপাত্ত বলছে কোনো ঝুঁকি নেই। তবে বিশেষজ্ঞরা সন্দেহ পোষণ করেছেন। কারণ, গর্ভাবস্থায় দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়াসহ অনেক পরিবর্তন আসে। সাধারণ জ্বরেও একই বয়সী অন্য নারীদের চেয়ে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি।
করোনাভাইরাসে শিশুদের মৃত্যুঝুঁকি কম মানে তারা আক্রান্ত হয় না, বিষয়টি কিন্তু তা নয়। এবার সবচেয়ে কম বয়সী আক্রান্ত শিশুটির বয়স ছিল মাত্র কয়েক দিন। কোভিড-১৯–এ শিশুদের লক্ষণের ব্যাপারে খুব কম তথ্যই পাওয়া গেছে। দেখা গেছে, শিশুদের ক্ষেত্রে এই অসুস্থতায় হালকা জ্বর, নাক দিয়ে পানি পড়া এবং কাশি থাকে।
করোনভাইরাসে শিশুরাও প্রচণ্ড অসুস্থ হতে পারে—এ ধারণা সাধারণ মানুষের মধ্যে থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। কারণ, সাধারণ জ্বরের ক্ষেত্রে দেখা যায়, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু, বিশেষ করে দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে অনেক বেশি ঝুঁকি ও জটিলতা দেখা যায়।
বয়স্করা কেন মারা যাচ্ছেন, এর দুটো জবাব দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, প্রাদুর্ভাবের উৎসের জায়গায় আক্রান্ত ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল থাকা এবং ভাইরাসের সঙ্গে দেহ খাপ খাওয়াতে না পারা। সবাই জানেন, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যায়।
অধ্যাপক হান্টারের মতে, ২০ বছর বয়সে দেহে যে মানের অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, তা ৭০ বছর বয়সে হয় না। এসব কারণে বয়স্ক ব্যক্তিদের আক্রান্তের ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি এবং কখনো কখনো তা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।