২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

ইরানের ভেতরে-বাইরে বিপদ বাড়ছে

ইরানের সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। ছবি: রয়টার্স
ইরানের সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। ছবি: রয়টার্স
>উড়োজাহাজ ভূপাতিত। বিক্ষোভে উত্তাল রাজধানী তেহরানসহ বড় শহরগুলো। এতে ট্রাম্পের সমর্থন ও ইরান সরকারকে হুঁশিয়ারি।

কয়েক দিন আগেও যাঁরা জেনারেল কাশেম সোলাইমানিকে শ্রদ্ধা জানাতে একসঙ্গে রাজপথে নেমেছিলেন, এখন তাঁরাই ইরান সরকারের পদত্যাগের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। এমনকি দেশটির সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিরও পদত্যাগ দাবি করেছেন। তেহরানে ইউক্রেনের একটি যাত্রীবাহী উড়োজাহাজকে ভুল করে ভূপাতিত করার কথা ইরান স্বীকার করার পরই দেশটির বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। এ ঘটনায় উড়োজাহাজের ১৭৬ জন আরোহী নিহত হন, যাঁদের অধিকাংশ হয় ইরানের নাগরিক অথবা ইরানি বংশোদ্ভূত। 

এই ঘটনায় দেশের ভেতরে–বাইরে বিপদ বাড়ছে ইরানের। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, প্রতিবাদকারীদের যেন হত্যা করা না হয়। ইউক্রেন, কানাডা, ব্রিটেনসহ একাধিক দেশ এই ঘটনায় ইরানের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ইউক্রেনের যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ ভূপাতিত করার ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগ এনে ক্ষমতাসীনদের তীব্র সমালোচনা করে গতকাল রোববার সংবাদ ও মতামত ছেপেছে ইরানের পত্রিকাগুলোও। সব মিলিয়ে এই ঘটনায় নতুন করে চাপে পড়েছেন ইরানের শাসকেরা।

এ অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদের উপস্থিতির কারণে যে অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়েছে, তা মোকাবিলায় ওই অঞ্চলের দেশগুলোকে নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা আরও জোরদার করার আহ্বান জানিয়েছেন খামেনি। গতকাল তেহরানে কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল–থানির সঙ্গে বৈঠকের পর নিজের সরকারি টুইটার অ্যাকাউন্টে তিনি এ আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘এ অঞ্চলে বর্তমানে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন আরও বেশি করে এখানকার দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করতে হবে। একই সঙ্গে বিদেশিদের প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন।’

আগের দিনের মতো গতকালও খামেনিসহ সরকারের পদত্যাগ চেয়ে রাজধানী তেহরানসহ বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ হয়েছে। বিক্ষোভে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্টও দেন অনেক ব্যবহারকারী। তেহরানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সড়কে জড়ো হওয়া বিক্ষোভকারীরা টুইটারে একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন। এতে বিক্ষোভকারীরা বলেন, ‘তারা (সরকার) মিথ্যা বলছে যে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের শত্রু। যুক্তরাষ্ট্র নয়, আমাদের শত্রু এখানেই আছে।’

৩ জানুয়ারি ইরাকের বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় নিহত হন ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডসের কুদস শাখার প্রধান মেজর জেনারেল কাশেম সোলাইমানি। ওই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে ইরাকে মার্কিন সেনাদের অবস্থান লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। এর কয়েক ঘণ্টা পর তেহরানে বিধ্বস্ত হয় ইউক্রেন আন্তর্জাতিক এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজ বোয়িং ৭৩৭। নিহত হন ১৭৬ আরোহী। প্রথমে ওই উড়োজাহাজ ভূপাতিত করার কথা অস্বীকার করলেও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে শনিবার ইরান স্বীকার করে, তাদের ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতেই উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয়েছে। তবে এটা ইচ্ছাকৃত নয়, শত্রুপক্ষের যুদ্ধবিমান ভেবে ভুলবশত এমনটা হয়েছে।

ওই স্বীকারোক্তির পর থেকে ইউক্রেনসহ পশ্চিমা দেশগুলো উড়োজাহাজ ভূপাতিত করার ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের দাবি জানাচ্ছে। ইরান প্রশাসনের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের অভিযোগ এনে শনিবার রাতে রাজধানী তেহরান, সিরাজ, ইস্পাহান, হামেদানের মতো বড় বড় শহরে শত শত মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। এদিন তেহরানের আমির কবির ইউনিভার্সিটি ও শরিফ ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির সামনে বড় বিক্ষোভ হয়। টুইটারে পোস্ট করা ভিডিওগুলোতে দেখা গেছে, আমির কবির ইউনিভার্সিটিতে জড়ো হওয়া শত শত শিক্ষার্থী ‘কমান্ডার ইন চিফ (আয়াতুল্লাহ খামেনি) পদত্যাগ করুন’ স্লোগান দেন। ‘স্বৈরশাসক নিপাত যাক, মিথ্যুকেরা ধ্বংস হোক’ বলেও স্লোগান দেন তাঁরা।

ইরানের রক্ষণশীল বার্তা সংস্থা ফার্সের খবরে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে সড়ক অবরোধ করেন। এতে চরম যানজটের সৃষ্টি হয়। পুলিশ তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে বলে। কিন্তু তাঁরা আদেশ অমান্য করলে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে দাঙ্গা পুলিশ। বিভিন্ন শহরে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

তেহরানের বাসিন্দারা বলেছেন, নতুন করে বড় বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়তে পারে—এমন আশঙ্কায় গতকাল সকাল থেকেই তেহরানে নিরাপত্তা জোরদার করেছে কর্তৃপক্ষ। মোড়ে মোড়ে সতর্ক টহল দিতে দেখা গেছে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের।

উড়োজাহাজ ভূপাতিত করার ঘটনায় দেরিতে ভুল স্বীকার করায় সরকারের সমালোচনা করেছে ইরানের সংস্কারপন্থী ও মধ্যপন্থী পত্রিকাগুলোও। সংস্কারপন্থী পত্রিকা এতিমাদ ইরানের ভুল স্বীকার নিয়ে ব্যানার শিরোনামে সংবাদ ছাপিয়েছে। ‘অ্যাপোলজি, রিজাইন (ক্ষমা চান, পদত্যাগ করুন)’ শিরোনামের ওই খবরে বলা হয়েছে, উড়োজাহাজ ভূপাতিত করার ঘটনা ধামাচাপার চেষ্টা করার জন্য যাঁরা দায়ী, তাঁদের পদত্যাগের দাবি জানিয়েছে জনগণ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের এই এলিট নিরাপত্তা বাহিনীর কোনো জবাবদিহি ছিল না। এখন সে দেশের মানুষ এই রেভল্যুশনারি গার্ডস বাহিনীর কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে এবং এই ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করতে চায়। দ্বিতীয়ত, জেনারেল কাশেম হত্যার ঘটনায় ইরান তিন দিন রাষ্ট্রীয় শোক পালন করলেও ইচ্ছাকৃতভাবে ১৭৬ জনকে হত্যার পরেও কোনো শোক পালন করা হয়নি। উপরন্তু দেশটির ক্ষমতাসীন অভিজাত গোষ্ঠী যেভাবে প্রথম থেকে ঘটনা ধামাচাপা দিতে চেয়েছে, তা ইরানের মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। আর এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আগেকার পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। এখন সেই ক্ষোভ ইরানের শাসকগোষ্ঠীর প্রশমিত করা সহজ হবে না। কারণ, কিছুদিন পরেই ইরানের পার্লামেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা। 

উড়োজাহাজ ভূপাতিত করার ঘটনাকে ‘অমার্জনীয় ভুল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তিনি। এ বিষয়ে শনিবার কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন রুহানি। ট্রুডোকে যথাযথ তদন্ত করার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।

উড়োজাহাজ ভূপাতিত করার কথা দেরিতে জনসমক্ষে প্রকাশের কথা স্বীকার করে ইরানের সেনাবাহিনীর বিশেষ বাহিনী রেভল্যুশনারি গার্ডসের শীর্ষ কমান্ডার ও দেশটির সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বলেছেন, ঘটনার দিনই তাঁকে বিষয়টি জানানো হয়েছিল।

আরেকটি মধ্যপন্থী পত্রিকা জোহুরি-ইয়ে এসলামির সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের ঘটনা দেরিতে প্রকাশ করা এবং ইরানের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বরখাস্ত করা অথবা পদত্যাগ করা উচিত।

ইরানজুড়ে শনিবার বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার পর বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশে ইংরেজি ও ফারসি ভাষায় টুইট করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘আমরা আপনাদের বিক্ষোভ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি এবং আপনাদের সাহস-অনুপ্রেরণা দিচ্ছি।’ ইরানের প্রশাসনকে সতর্ক করে তিনি বলেন, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে আবারও হত্যাকাণ্ড অথবা ইন্টারনেট বন্ধের ঘটনা ঘটানো যাবে না। বিশ্ব দেখছে। সর্বোপরি যুক্তরাষ্ট্র এদিকে লক্ষ রাখছে।