ইরাকে যৌন নিপীড়নের মূল শিকার ছেলেরা
ইরাকে মৌখিক যৌন হয়রানি এবং শারীরিক যৌন নিপীড়ন নিয়ে যত অভিযোগ এসেছে, এতে নারীর চেয়ে অভিযোগকারী পুরুষের সংখ্যা অনেক বেশি। বিবিসি অনলাইনের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে ইরাকে বালক বয়সী ছেলেদের যৌন হেনস্তার এই চিত্র তুলে ধরা হয়।
ইরাকের আর দশটি সাধারণ ছেলের মতো দিন কাটছিল সামির (ছদ্মনাম)। ১৩ বছর বয়সে সামির প্রথমবারের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত অভিজ্ঞতা হয়। স্কুলের শৌচাগারে বড় ক্লাসের ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী তিনটি ছেলে তার ওপর চড়াও হয়। সামির শরীরের বিভিন্ন সংবেদনশীল অংশ স্পর্শ করতে থাকে তারা। শুরুতে বরফের মতো জমে যায় সামি। তারপর গলা ফাটিয়ে চিৎকার।
সামির চিৎকার গোটা স্কুলে আলোড়ন। প্রধান শিক্ষকের হস্তক্ষেপে ওই তিনজনকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তবে তাদের অভিভাবকদের জানানো হয়নি কোন অপরাধে ছেলেদের এই সাজা হলো। সামিকে ডেকে নিয়ে প্রধান শিক্ষক যা শোনালেন, তাকে দ্বিতীয় দফা ধর্ষণচেষ্টা বলা হলেও অত্যুক্তি হবে না।
প্রধান শিক্ষক বললেন, সামি যদি এই ঘটনা পরিবার বা স্কুলের বাইরের কোনো সদস্যকে জানায়, তবে ধরে নেওয়া হবে সেদিন শৌচাগারে যা হয়েছিল, ওতে সামিরও সম্মতি ছিল। কাজেই সামিকেও স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হবে। যদি সে স্কুলে থাকতে চায়, তাহলে সেদিনের ঘটনা বেমালুম চেপে যেতে হবে। এই দ্বিতীয় সুযোগ সামি নেবে কি না, সে সিদ্ধান্ত তাকেই নিতে হবে।
ভয়ে গুটিসুটি সামি কাউকে কিছু না জানিয়ে স্কুলে থাকাটাই শ্রেয় মনে করল। কিন্তু বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে তার যোগাযোগ একদম কমে যেতে থাকল। প্রথম যৌন নিপীড়নের ধাক্কা তাকে দীর্ঘদিন হতবাক করে রাখে।
এ ঘটনার ঠিক দুই বছর পরের কথা। এক বছর হলো সামির বাবা মারা গেছেন। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে সামির পরিবার তখন বেহাল। ইরাকের ব্যাবিলন শহরে মোটামুটি আর্থিক সচ্ছলতার মধ্য দিয়ে বড় হওয়া সামি হঠাৎ করে টের পেল দারিদ্র্য কাকে বলে। স্কুল ছেড়ে স্থানীয় বাজারের এক দোকানে চাকরি নিল সে। সেখানে দ্বিতীয়বারের মতো অসহ্য সেই অভিজ্ঞতা হয় কিশোর সামির।
দোকানের মালিক খুব ভালোবাসতেন সামিকে। একদিন দোকানে কেবল তাঁরা দুজনই ছিলেন। সামিকে দোকানের এক কোনায় ডেকে নিয়ে চুমু খাওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। হাতের কাছে কাচের পাত্র পেয়ে তা দিয়েই লোকটার মাথায় আঘাত করে দৌড়ে পালিয়ে যায় ছেলেটা। স্থানীয় লোকজনকে মালিক কী বুঝিয়েছিলেন, তা তিনিই জানেন। তবে আরেকটি চাকরি পেতে প্রায় এক বছর লেগে যায় সামির।
সামির বয়স তখন ১৬। অন্য ভাইবোনদের নিয়ে বাড়ির বাইরে গেছে তার মা। বাড়িতে বেড়াতে আসা এক চাচাতো ভাই হুট করেই মুঠোফোনে পর্নো গ্রাফিক ছবি বের করে সামিকে দেখাতে লাগল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সামিকে বিছানার সঙ্গে চেপে ধরে বলাৎকার করে ওই ছেলে। সে ঘটনার কথা মনে পড়লে এখনো দুঃস্বপ্নের মতো লাগে সামির।
এ ঘটনার পর শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িতে আর থাকার সাহস হয়নি তার। পরিবারকে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে ওই গ্রাম থেকে বাগদাদে চলে আসে তারা। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব সবার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে সে। তবে কারও সঙ্গে রোমান্টিক সম্পর্কে জড়ানোর সাহস সামির হয়নি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সামি বুঝতে পারে, এই দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার ভার একা বয়ে বেরালে আজীবন তাকে তাড়া করে ফিরবে কালো অতীত। কাজেই খুব কাছের বন্ধুদের এক আড্ডায় নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে সে। তবে বন্ধুদের প্রতিক্রিয়ায় রীতিমতো আঁতকে ওঠে সামি। সে একা নয়, তার অধিকাংশ বন্ধুই জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে।
বিবিসি নিউজ আরবির এক জরিপ অনুযায়ী, আরব বিশ্বের ১০টি দেশের মধ্যে ইরাক এবং তিউনিসিয়ায় নারীদের চেয়ে পুরুষের ওপর যৌন হয়রানির মাত্রা বেশি। তিউনিসিয়ায় এই হার নারীদের চেয়ে মাত্র ১ শতাংশ বেশি হলেও ইরাকের ৩৯ শতাংশ পুরুষ যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে বলে জানিয়েছে। ইরাকের ১৭ শতাংশ নারী শারীরিকভাবে যৌন হেনস্তার শিকার হয়, যেখানে পুরুষদের ক্ষেত্রে এই হেনস্তার হার ২০ শতাংশের বেশি।
ইরাকের ছেলেদের সঙ্গে পারিবারিক সহিংসতার ঘটনাও ঘটে।
ইরাকি সংবিধানের কথা মাথায় রেখে এই জরিপের ফলাফলকে খুব বেশি বিস্ময়করও বলা যায় না। কারণ, দেশটির সংবিধানের ৪১ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, স্বামী তাঁর স্ত্রীর গায়ে হাত তুললে সেটি আইনত দণ্ডনীয় কোনো অপরাধই নয়। তা ছাড়া যৌন নিপীড়নের শিকার নারীদের মধ্যে চুপ করে থাকার প্রবণতাও বেশি দেখা যায়। কাজেই জরিপে মেয়েদের যৌন নিপীড়নের প্রকৃত হার উঠে এসেছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
সুইডেন ভিত্তিক এনজিও ইরাক্যুয়েরের প্রতিষ্ঠাতা আমির অশোর বলেন, ইরাকে সমকামী এবং তৃতীয় লিঙ্গের পুরুষেরা তুলনামূলক বেশি যৌন হয়রানির শিকার হয়। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, কেউ যদি দেখতে বা আচরণগতভাবে নারীসুলভ হয়, তবে তার ওপর যৌন সহিংসতার ঘটনা বিরল নয়।
সামির বয়স এখন ২১। বন্ধুদের সহায়তায় বীভৎস সব অভিজ্ঞতা পেছনে ফেলে এসেছেন। ইরাকের নিপীড়নমূলক সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটবেই—এই প্রত্যাশায় এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি।