ইমেলদা মার্কোস: বিলাসী জীবন ও বিতর্ক যাঁর সঙ্গী
ইমেলদা মার্কোস ফিলিপাইনের সাবেক ফার্স্ট লেডি। দেশটির নির্বাসিত স্বৈরশাসক ফার্দিনান্দ মার্কোসের স্ত্রী তিনি। তবে ফ্যাশন সচেতনতা, অভিজাত ও বিলাসী জীবনযাপনের জন্য বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পেয়েছেন তিনি। তবে জীবনভর বিতর্ক পিছু ছাড়েনি ইমেলদার। কখনো সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ, কখনো বিলাসী জীবনের জন্য তিনি খবরের শিরোনাম হয়েছেন। সম্প্রতি খোয়া যাওয়া একটি চিত্রকর্মের জন্য আবারও সমালোচিত হয়েছেন ৯৩ বছর বয়সী ইমেলদা। পাবলো পিকাসোর আঁকা চিত্রকর্মটি তাঁর ঘরের দেয়ালে দেখা গেছে।
ইমেলদার জন্ম ১৯২৯ সালের ২ জুলাই, ফিলিপাইনের ম্যানিলায়। আগের নাম ইমেলদা রেমেদিওস ভিসিতাসিওন রমুয়ালদেজ। বাবা রেমেদিওস ত্রিনিদাদ ও মা ভিসেন্তে রমুয়ালদেজের পাঁচ সন্তানের একজন ইমেলদা। শৈশব থেকেই ভীষণ সুন্দরী ছিলেন। ১৯৫০-এর দশকে ম্যানিলায় একটি দোকানে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার জন্য গান গাইতেন। পরে ‘মিস ম্যানিলা’ সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে দ্বিতীয় হন তিনি।
১৯৫৪ সালে ফার্দিনান্দ মার্কোসের সঙ্গে বিয়ে হয় ইমেলদার। তাঁর নাম হয় ইমেলদা মার্কোস। ফার্দিনান্দ মার্কোস তখন ন্যাশিওনালিস্তা পার্টির হয়ে ফিলিপাইনের কংগ্রেসে সদস্য। মার্কোস-ইমেলদার সংসারে চার সন্তান। তাঁদের মেয়ে ইমি মার্কোস ফিলিপাইনের সিনেটর। আর ছেলে ফার্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়র (বংবং নামে পরিচিত) গত সপ্তাহে দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় পেয়েছেন।
ফার্দিনান্দ মার্কোস ১৯৬৫ সালের নভেম্বরে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট হন। ওই সময় ফার্স্ট লেডি হিসেবে দারুণ জনপ্রিয় ছিলেন ইমেলদা। তবে ফার্দিনান্দের শাসনামলে তুমুল সমালোচিত হন তিনি। মার্কোস দুই দশকের বেশি সময় দেশ শাসন করেন। তাঁর শাসনামলে তিন হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। কথিত আছে, অন্যদের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দিতে লোকজনকে মেরে লাশ রাস্তার পাশে ফেলে রাখা হতো।
যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে ১৯৬৯ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট পদে জয়লাভ করেন ফার্দিনান্দ মার্কোস। তিন বছর পর দেশে সামরিক আইন জারি করেন তিনি। তাঁর দাবি, কমিউনিস্টদের (সমাজতন্ত্রী) হাত থেকে জাতিকে বাঁচাতে সামরিক আইন জারির বিকল্প ছিল না। ১৯৮৩ সালে বিরোধী নেতা বেনিগনো অ্যাকুইনো জুনিয়র আততায়ীর হাতে নিহত হলে ফিলিপাইনে মার্কোস পরিবারের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি বিক্ষোভ শুরু হয়। তুমুল জনরোষের মুখে ১৯৮৬ সালে ক্ষমতা ছেড়ে সন্তানদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসনে যান ফার্দিনান্দ-ইমেলদা দম্পতি।
ফার্দিনান্দ মার্কোসের শাসনামলে ফিলিপাইনে অনেক মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছিলেন। অথচ মার্কোস পরিবার তখন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ও ক্যালিফোর্নিয়ায় সম্পত্তি কেনে। এই পরিবারের সদস্যরা বিলাসী জীবন যাপন করছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে বিপুল অঙ্কের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। ১৯৮৬ সালে যখন বিক্ষোভকারীরা ম্যানিলায় প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে ঢুকে পড়েন, তখন সেখানে তাঁরা মার্কোস পরিবারের সংগ্রহে থাকা অসংখ্য মূল্যবান তৈলচিত্র, শিল্পকর্ম, দামি গয়না, রত্নপাথর, ১৫টি মিংক কোট, ৫০৮টি ডিজাইনের গাউন দেখতে পান।
বিক্ষুব্ধ জনতা যখন প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে ঢুকে পড়েছিলেন, তখন সেখানে ছিলেন মার্কিন সাংবাদিক জিম লরি। তিনি বলেন, ইমেলদার সাজঘরে গিয়ে দেখা গেল সেখানে শত শত ডিজাইনের গাউন রয়েছে। নিউইয়র্ক, প্যারিস, রোমের নামকরা বিভিন্ন ফ্যাশন ব্র্যান্ডের লেবেল তখনো ছেঁড়া হয়নি। তিনি হয়তো সেগুলোর অধিকাংশ একবারও পরেননি। পাশেই রয়েছে ইমেলদার দামি দামি জুতার বিশাল সংগ্রহ। সংখ্যায় তা তিন সহস্রাধিক।
সাংবাদিক জিম লরি আরও বলেন, ফিলিপাইন খুব গরিব দেশ। যখন আপনি এর সঙ্গে তুলনা করে বিষয়টি দেখবেন, তখন বুঝতে পারবেন এই বিলাসিতা কতটা দৃষ্টিকটু। তবে ফার্স্ট লেডি ইমেলদার জুতা-জামা-গয়নার পেছনে এমন ব্যয়ের নজির মার্কোসের শাসনামলের দুর্নীতির ব্যাপকতার একটি ক্ষুদ্র প্রমাণ মাত্র। এই পরিবার কোটি কোটি ডলার বিদেশে পাচার করেছে। পশ্চিমা বিশ্বে বিনিয়োগ করেছে।
১৯৮৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মারা যান ফার্দিনান্দ মার্কোস। এরপর সন্তানদের নিয়ে ফিলিপাইনে ফিরে আসেন ইমেলদা। নব্বইয়ের দশকে শুরু করেন রাজনীতি। দেশটির ইলোকোস নর্তে অঞ্চল থেকে কংগ্রেসের সদস্য নির্বাচিত হন। রাজনীতি শুরু করেন তাঁর দুই সন্তানও।
ইলোকোস নর্তে অঞ্চলটি মার্কোস পরিবারের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত। সেখানে স্প্যানিশ কায়দায় তৈরি এক রাজকীয় প্রাসাদ রয়েছে তাঁদের। মার্কোস পরিবারের তীর্থ বলে পরিচিত এই বাড়ি এখন জনগণের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে। মার্কোসের সমর্থকেরা এখানে এসে মার্কোস ও ইমেলদার রাজকীয় ছবির সামনে ছবি তোলেন। তাঁদের থাকার ঘরগুলো ঘুরে দেখেন।
নির্বাসনে থাকাকালে ইমেলদার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি প্রতারণার মামলা হয়। বড় অঙ্কের অর্থ পাচারের অভিযোগে এক মামলায় ২০১৮ সালে তাঁকে ১১ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ইমেলদা ওই অভিযোগ অস্বীকার করে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে জামিন নেন। ওই বছর ইমেলদা সাতটি মামলায় আপিল করেন। মার্কোস পরিবারের বিরুদ্ধে এখনো চুরি করা সম্পদ নিয়ে কয়েক ডজন মামলা চলছে।
২০১৯ সালে আবারও খবরের শিরোনাম হন ইমেলদা। তাঁর ৯০তম জন্মদিনের আসর বসেছিল ম্যানিলার অভিজাত এলাকা প্যাসিগ সিটির ইনারিস স্পোর্টস সেন্টারে। আমন্ত্রিত ছিলেন প্রায় আড়াই হাজার অতিথি। ওই আয়োজনে খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ২৬১ জন। তাঁদের মধ্যে খাদ্যে বিষক্রিয়ার লক্ষণ দেখা দেয়। আর এবার ইমেলদা বিতর্কে জড়ালেন চিত্রকর্ম নিয়ে।
নির্বাচনে জয়ের পর বংবং মার্কোস মা ইমেলদার সঙ্গে তাঁর ম্যানিলার বাড়িতে গিয়ে দেখা করেন। এ সময় তোলা মা ও ছেলের একটি ছবি প্রকাশ করা হয়। তাতে ইমেলদার ঘরের দেয়ালে ঝোলানো একটি চিত্রকর্ম সবার নজর কাড়ে। সেটি বিশ্বখ্যাত স্প্যানিশ চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসোর আঁকা ‘ফেম কোচ সিক্স’। ফিলিপাইনের দুর্নীতি দমন কর্তৃপক্ষ ২০১৪ সাল থেকে খোয়া যাওয়া যে আটটি চিত্রকর্ম উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, এটি তার একটি।
যদিও বিষয়টি নিয়ে মার্কোস পরিবার এখনো মুখ খোলেনি। এটি প্রকৃত চিত্রকর্ম, নাকি রেপ্লিকা (নকল) পরিবারটির পক্ষ থেকে তা জানানো হয়নি। বিষয়টি নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। তবে মার্কোস জুনিয়র ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর এই চিত্রকর্ম এখন উদ্ধার করা যাবে কি না, তা স্পষ্ট নয়।
বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ান ও নিউইয়র্ক টাইমস অবলম্বনে লিখেছেন অনিন্দ্য সাইমুম ইমন।