ইন্দোনেশিয়ায় সামাজিক মাধ্যমে রাশিয়ার প্রতি সমর্থন যে কারণে

ইন্দোনেশিয়ার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের মধ্যে বাড়ছে রাশিয়ার প্রতি সমর্থন
ছবি: রয়টার্স

কয়েক সপ্তাহ ধরে ইন্দোনেশিয়ার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি গল্প ঘুরছে। গল্পটি সদ্য বিচ্ছেদ হওয়া এক দম্পতিকে নিয়ে। স্ত্রীর প্রতি অনুরক্ত এক ব্যক্তির বিবাহবিচ্ছেদ হয়। বিচ্ছেদের পরও ওই ব্যক্তি সাবেক স্ত্রীর প্রতি এতটাই কোমল হৃদয় ছিলেন যে স্ত্রীর যাবতীয় পাওনা পরিশোধ করেন এবং তিন সন্তানকে তার জিম্মায় দিয়ে দেন। কিন্তু এরপরই ঘটে বিপত্তি। ওই নারীর সঙ্গে প্রতিবেশী এক ধনী ব্যক্তির সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই খবর শুনে সাবেক স্বামী প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন। একপর্যায়ে একটি সন্তানকে নিজের কাছে নিয়ে যান তিনি। তাদের বাকি দুই সন্তান তখন বলে, বাবা তাদের মাকে শৃঙ্খলার মধ্যে এনেছেন।

আপাতদৃষ্টিতে এটিকে টেলিভিশনে প্রচারিত কোনো নাটকের সঙ্গে তুলনা করলেও এর অন্তর্নিহিত প্রভাব রয়েছে। কারণ, এই গল্পে প্রচলিত সমাজে নারীকে দোষ দেওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠেছে। পাশাপাশি পারিবারিক সহিংসতার চিত্রও উঠে এসেছে।

তবে এটি মূলত রুশপন্থী একধরনের বার্তা। যেখানে রাশিয়াকে ওই পুরুষের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, ইউক্রেনকে তার সাবেক স্ত্রী আর যুক্তরাষ্ট্রকে তুলনা করা হয়েছে ধনী ব্যক্তির সঙ্গে। অন্যদিকে ক্রিমিয়া, দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলকে তিন সন্তান হিসেবে প্রতীকায়িত করা হয়েছে।

গল্পটি প্রথম দেখা যায় চীনের জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উইবোতে। রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর পরপরই এটি উইবোতে ছড়িয়ে পড়ে। এরপরই ইন্দোনেশিয়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার ও ফেসবুকেও গল্পটি ভাইরাল হয়ে যায়। এতে প্রমাণিত হয়, ইন্দোনেশিয়ার নাগরিকদের মধ্যে রাশিয়ার প্রতি সমর্থন বাড়ছে, যেটি অবাক করার মতো।

ইন্দোনেশিয়ার সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের পলিটিকস অ্যান্ড সোশ্যাল চেঞ্জ বিভাগের গবেষক আলিফ সাতরিয়া আল-জাজিরাকে বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রুশপন্থী বিষয়গুলো ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার প্রতি ইন্দোনেশিয়ার জনগণের মধ্যে সমর্থন বাড়াবে।

ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদাদো ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন
ছবি: রয়টার্স

আলিফ সাতরিয়া বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের মিমস ও ছবি ব্যবহার হচ্ছে এবং ইন্দোনেশিয়ার জনগণ সেগুলোর প্রতি আকৃষ্টও হচ্ছে। এসব কনটেন্টে রাশিয়াকে দায়িত্বশীল স্বামীর ভূমিকায় তুলে ধরা হয়েছে, যে তার অকৃতজ্ঞ সাবেক স্ত্রীকে (ইউক্রেন) ফিরিয়ে আনতে চায়। আর তার স্ত্রী ইউরোপীয় সহযোগীদের নিয়ে সন্তান ও আদিবাসী রাশিয়ানদের জিম্মি করে রেখেছে।’

এসব চিত্রের মাধ্যমে তিন সপ্তাহ ধরে চলা ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ইন্দোনেশিয়ায় দুটি ধারা সৃষ্টি হয়েছে। ইন্দোনেশিয়া সরকার প্রত্যক্ষভাবে রাশিয়াকে সমর্থন না করলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং অনলাইনে রাশিয়ার প্রতি সহানুভূতি ফুটে উঠেছে।

তবে ইউক্রেনে হামলার পর ইন্দোনেশিয়া সরকারের রাশিয়াবিরোধী অবস্থান স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে। ইউক্রেনে হামলার জন্য রাশিয়ার নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় দেশটি। এই যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের পক্ষের প্রস্তাবেও ভোট দেয় ইন্দোনেশিয়া। এ ছাড়া ৯ মার্চ নিক্কেই এশিয়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদাদো চলমান সংঘাত বন্ধে দুই দেশকে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান।

ইন্দোনেশিয়ার বান্দুংয়ের জেনদেরাল আচমাদ ইয়ানি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রভাষক ইয়োহানেস সুলাইমান বলেন, রাশিয়ার প্রতি সমর্থনের পেছনে যে কারণটি কাজ করছে তা হলো ইন্দোনেশিয়ার অনেক মানুষ যুক্তরাষ্ট্রকে অপছন্দ করে। আগে রাশিয়ার চেচনিয়া যুদ্ধ ও সিরিয়ায় জঙ্গিদের ওপর হামলার প্রতিবাদ হলেও এবার দেখা যাচ্ছে ভিন্ন অবস্থা। তাঁর মতে, যুক্তরাষ্ট্রকে অপছন্দ করার কিছু কারণও রয়েছে। নাইন-ইলেভেনের পর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ চালায় তারা। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইন্দোনেশিয়ানদের অবিশ্বাস জন্ম নেয়।

ইউহানেস সুলাইমান বলেন, ইন্দোনেশিয়ার যেসব নাগরিক রাশিয়ার সমর্থক, তারা যুক্তরাষ্ট্রকে পছন্দ করে না, দেশটিকে বিশ্বাসও করে না। নাইন-ইলেভেনের পর নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে আফগানিস্তানে হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে গণবিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ এনে ইরাকে হামলা করে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্রের এমন যুদ্ধের মনোভাবকে ষড়যন্ত্র হিসেবে মনে করে ইন্দোনেশিয়ানরা।

২০২০ সালে ওয়াশিংটন ডিসির পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক গবেষণায় দেখা যায়, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলভুক্ত দেশের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়ে ইন্দোনেশিয়া বেশি সংশয়প্রবণ। এতে জানা গেছে, ইন্দোনেশিয়ার জনগণের মাত্র ৪২ শতাংশ মনে করে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের জন্য উপকারী।

অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়ানরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে চলা যুদ্ধের সঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধকে তুলনা করেছে। জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া। দেশটির ২৭ কোটি মানুষের মধ্যে ৯০ শতাংশই মুসলিম হওয়ায় ঐতিহ্যগতভাবেই ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর তাদের সহমর্মিতা অনেক বেশি। এ কারণে ইসরায়েলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কোনো সম্পর্ক নেই দেশটির।

ইন্দোনেশিয়ার এয়ারলাঙ্গা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রভাষক রাদিও ধর্মপুত্র বলেন, গত কয়েক বছরে দ্বীপরাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে কাজ করছে রাশিয়া। বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে রাশিয়া নিজেকে ইসলামের বন্ধু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতেও চাইছে।

অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য লেখা একটি ব্লগে রাদিও ধর্মপুত্র বিষয়টি তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, জাকার্তায় একটি বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছে রাশিয়া। এ ছাড়া ইন্দোনেশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে রুশ ভাষা পড়ানো হচ্ছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে রাশিয়ান স্টাডিজ পড়ার জন্য শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে বৃত্তির ব্যবস্থাও করেছে রাশিয়া।