নাগাসাকিতে পারমাণবিক হামলার বার্ষিকী ঘিরে বিতর্ক ও ভবিষ্যতের শঙ্কা

আণবিক বোমায় বিধ্বস্ত নাগাসাকিছবি: সংগৃহীত

এটা নতুন কোনো খবর নয়। তবে তাৎপর্য বিবেচনায় সংবাদটি বিস্তৃত আলোচনার দাবি রাখে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে ১৯৪৫ সালের ৯ আগস্ট জাপানের নাগাসাকি শহরের ওপর দ্বিতীয় পারমাণবিক বোমা ফেলেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এর তিন দিন আগে হিরোশিমাকেও একই ভাগ্য বরণ করে নিতে হয়। দুটি শহরে তাৎক্ষণিকভাবে নিহতের সংখ্যা ছিল দেড় লাখের ওপরে। বছর ঘুরে যাওয়ার আগেই এই সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এর বাইরে দুটি শহরই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। বাস্তুহারা হয়ে পড়েছিলেন লাখো মানুষ। শারীরিক আঘাত নিয়ে অনেককে বাকি জীবন কাটাতে হয়েছে প্রতিবন্ধী হয়ে।

তবে সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো, পারমাণবিক বোমা হামলার তেজস্ক্রিয় বিকিরণের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, সে সম্পর্কে অজ্ঞতা। সেই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে কী করতে হবে, তা না জেনে ও না বুঝে অনেকেই বিপদের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন। বিভিন্ন রোগ ও উপসর্গ নিয়ে সারা জীবন ভুগতে হয়েছে তাঁদের। অনেকে অকালে প্রাণ হারিয়েছেন। তবে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয়েছে যাঁরা দীর্ঘদিন বেঁচে ছিলেন। জাপানে তাঁরা ‘হিবাকুশ’ নামে পরিচিত। তাঁদের অনেকেই নিয়মিতভাবে সেই দুর্দশার কথা বর্ণনা করে গেছেন। বলেছেন, বিশ্বের কোথাও যেন আর সেই অভিশাপের পুনরাবৃত্তি না ঘটে।

হিবাকুশদের মধ্যে অনেকেই জীবিত আছেন। চলতি বছরের মার্চ মাসের শেষে তাঁদের সংখ্যা ছিল এক লাখের সামান্য বেশি। তাঁদের গড় বয়স ৮৫ বছর।

হিবাকুশদের মধ্যে অনেকেই জীবিত আছেন। চলতি বছরের মার্চ মাসের শেষে তাঁদের সংখ্যা ছিল এক লাখের সামান্য বেশি। তাঁদের গড় বয়স ৮৫ বছর। পারমাণবিক বোমা হামলা থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া এ ধরনের মানুষের সংখ্যা প্রতিবছর কমে আসছে। তবে যাঁরা এখনো সক্রিয় আছেন, তাঁরা পারমাণবিক বিশ্বের বিপদ সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করার প্রচার কাজ থেকে থেমে যাননি। অনলাইনে এ ধরনের একজনের সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম এ বছর নাগাসাকির বোমা হামলা বার্ষিকীর আগে।

১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসে ইচিরো মিসে নামের হিবাকুশা ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র। বোমা হামলার কেন্দ্রস্থল থেকে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে ছিল তাঁর বাড়ি। বোমা হামলার কয়েক দিন পর নিজের স্কুল ভবনের অবস্থা দেখতে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে তিনি যা দেখেছিলেন, তা ছিল এক বিভীষিকা। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন আহত লোকজন। কেউ কেউ পানির জন্য চিৎকার করছেন। অনেকে চাইছিলেন মৃত্যু যেন দ্রুত তাঁদের সেই নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে এগিয়ে আসে। স্কুলের খেলার মাঠের একদিকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। যেখানে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়া মরদেহগুলো পোড়ানো হচ্ছিল।

ইচিরো মিসে সেদিন অক্ষত অবস্থায় বাড়ি ফিরে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শ থেকে অল্প কিছুদিনের মধ্যে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, যা তাঁকে আজও ভোগাচ্ছে। তবে তা সস্ত্বেও তিনি প্রচার কাজ থামিয়ে দেননি। ইদানীং সেই তাগিদ আরও বেশি অনুভব করছেন বিশ্ব এখন নতুন এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যা হিরোশিমা-নাগাসাকির চেয়ে অনেক গুণ শক্তিশালী তাণ্ডব শুরু করে দিতে পারে। যার ফলে বিপন্ন হতে পারে এই পৃথিবীতে মানবসভ্যতার অস্তিত্ব।

নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত সেই বোমা
সংগৃহীত

তবে ইচিরো মিসের মতো ব্যক্তিরা আমাদের বিবেককে জাগ্রত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলেও আমাদের বিবেক যে জাগ্রত হচ্ছে না, তা নাগাসাকিতে এবারের বোমা বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া অনাহূত কিছু ঘটনা এর পরিষ্কার ইঙ্গিত দিচ্ছে। ৯ আগস্টের নাগাসাকি বোমা হামলার বার্ষিকীর আগে শহরের মেয়র সুজুকি শিরো এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করেছিলেন, গাজা ভূখণ্ডে চলা তাণ্ডবলীলার আলোকে এবারের বার্ষিকীতে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূতকে আমন্ত্রণ জানানো থেকে তিনি বিরত থাকবেন।

সুজুকি শিরো পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছিলেন, তাঁর সে সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিক অবস্থান থেকে নয়; বরং মানবিক অবস্থান থেকে দেখা উচিত। কারণ, ইউক্রেনে চালানো আগ্রাসনের আলোকে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতকেও স্মারক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো থেকে তিনি বিরত আছেন। তবে পশ্চিমা বিশ্ব মনে করে, ইসরায়েল ও রাশিয়াকে এক করে দেখার কোনো উপায় নেই।

যদিও গাজায় দেশটির অমানবিক আচরণ হচ্ছে তুলনামূলক অবস্থান থেকে অনেক বেশি বীভৎস। তবে নিজের দলের একেবারে আপনজন বলে কথা! ইসরায়েলের অমানবিক আচরণে পশ্চিমা দেশ যে কেবল চোখ বন্ধ করে নেই; বরং পেছনে ইন্ধন জুগিয়ে চলেছে নাগাসাকির ঘটনা, কিন্তু তা পরিষ্কার দেখিয়ে দিচ্ছে।

আণবিক বোমা ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছিল নাগাসাকিকে
ছবি: সংগৃহীত

নাগাসাকির মেয়রের বক্তব্যের ঠিক পরপরই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাপান ছাড়া বিশ্বের অগ্রসর দেশগুলোর জোট জি-সেভেনের ছয়টি দেশের জাপানে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতেরা সম্মিলিত ঘোষণায় জানিয়ে দিয়েছিলেন, ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূতকে স্মারক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ না জানানোয় তাঁরাও সে অনুষ্ঠান বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা থেকেই তাঁরা কেবল বিরত থাকেননি, নাগাসাকির মেয়রের সিদ্ধান্তকে হেয় করার চেষ্টাও চালিয়ে গেছেন নানাভাবে।

ইচিরো মিসে সেদিন অক্ষত অবস্থায় বাড়ি ফিরে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শ থেকে অল্প কিছুদিনের মধ্যে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, যা তাঁকে আজও ভোগাচ্ছে।

এটাই হচ্ছে বিশ্বের এ সময়ের বাস্তবতা। বিশ্বকে পরমাণু অস্ত্র মুক্ত করতে হিবাকুশাদের চালিয়ে যাওয়া নিরলস প্রচেষ্টা। বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আকাঙ্ক্ষা সব কিছুকেই এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে প্রভাবশালী দেশের রাষ্ট্রদূতেরা দেখিয়ে দিলেন নিজের ঘনিষ্ঠ মিত্রের সম্মানে কতটা পক্ষপাতমূলক তাঁরা হতে পারেন। ফলে ইচিরো মিসের মতো হিবাকুশাদের চালিয়ে যাওয়া নিরলস প্রচেষ্টা এবং সারা বিশ্বের সংখ্যাধিক্য মানুষের আকাঙ্ক্ষা বিশ্বকে পরমাণু অস্ত্র থেকে মুক্ত করতে কতটা সাফল্য নিয়ে আসবে, সেই বিশ্বাসে চির ধরার খুব বেশি বাকি আছে বলে মনে হয় না। এরপরও আমরা আশাবাদী। কারণ, বোমা হামলার ভুক্তভোগীদের সংখ্যা কম হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা যে ঐতিহ্য রেখে যাচ্ছেন, সেই আদর্শ থেকে সরে আসা আমাদের আসন্ন বিপর্যয়কে করে তুলবে আরও বেশি অবশ্যম্ভাবী।