তুরস্কে জরিমানা দিয়ে বৈধ করা হয়েছিল বিধি না মানা ভবন, সেগুলো এখন ধ্বংসস্তূপ
কিছুদিন আগেও যেখানে ছিল সুউচ্চ সব ভবন, সেখানে এখন ইট, পাথর আর কংক্রিটের চাঁই। যত দূর চোখ যায়, এমন ধ্বংসস্তূপ। চিত্রটা তুরস্কের। গত সোমবারের শক্তিশালী ভূমিকম্পে ধসে পড়া এসব ভবনের অনেকগুলোই গত কয়েক বছরে নির্মাণ করা। এ নিয়ে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে তুরস্কে। অভিযোগ উঠেছে, এসব ভবন নির্মাণের সময় যথাযথ আইন মানা হয়নি। আর এ আইন মানা না মানা নিয়ে দেশটির সরকার অতটা কঠোরও নয়।
সোমবার ভোরে তুরস্ক ও সিরিয়া সীমান্তবর্তী অঞ্চলে আঘাত হানা ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৮। এ মাত্রার ভূমিকম্প খুবই শক্তিশালী। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবনগুলো যদি মান বজায় রেখে নির্মাণ করা হতো, তাহলে এ ভূমিকম্পের পরও সেগুলো টিকে থাকার কথা ছিল।
ভূমিকম্পে তুরস্কে সম্প্রতি নির্মাণ করা ভবন ধসে পড়ার অভিযোগগুলো যাচাই–বাছাই করে দেখেছে বিবিসি। সেখানে এসব অভিযোগের অনেকগুলোর সত্যতা পাওয়া গেছে।
বলা চলে মালাতইয়া শহরের একটি ভবনের কথাই। গত বছরেই ভবনটির নির্মাণ শেষ হয়েছিল। এ নিয়ে প্রচারও চালিয়েছিল ভবনটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। একটি বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছিল, ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে সেরা মানের কাঁচামাল দিয়ে। আর নির্মাণের সময় ভূমিকম্পসংক্রান্ত সরকারের নতুন আইন মানা হয়েছে।
ভূমিকম্পে ওই ভবনটি ভেঙে পড়ার পর বিজ্ঞাপনগুলো আবার সামনে এসেছে। অনেকেই সেগুলো ইন্টারনেটে প্রকাশ করছেন। ভবনটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে অবশ্য বিজ্ঞাপনগুলো এখন আর নেই। তবে সেখানে তাদের অন্য ভবনের একই ধরনের বিজ্ঞাপন দেখা গেছে।
এ ভূমিকম্পের তীব্রতা ছিল ব্যাপক। তবে ততটা নয় যে শক্তপোক্তভাবে নির্মাণ করা ভবনগুলো ধসে পড়বে। বেশির ভাগ এলাকায় কম্পন ছিল সেদিনের সর্বোচ্চ মাত্রার চেয়ে কম। তাই আমরা এটা বলতে পারি যে হাজার হাজার ভবন-যেগুলো ধসে পড়েছে, সেগুলোর প্রায় সবই ভূমিকম্পসংক্রান্ত নির্মাণ আইন মেনে গড়ে তোলা হয়নিডেভিড আলেকজান্ডার, অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন
তুরস্কের ইস্কেন্দেরুন শহরে ধসে পড়া আরেকটি বহুতল ভবনের ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে। ওই ভবনের নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের প্রকাশিত ছবি অনুযায়ী সেটির কাজ ২০১৯ সালে শেষ হয়েছিল। এ নিয়ে কথা বলতে ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল বিবিসি। তবে তাদের কাছ থেকে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
জবাব না দিলেও ২০১৯ সালের নভেম্বরে ভবনটি উদ্বোধনের একটি ভিডিও বিবিসির হাতে এসেছে। সেখানে দেখা গেছে, ওই নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের মালিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলছেন, ‘এই প্রকল্প অন্যগুলোর তুলনায় আলাদা। কারণ, অবস্থান এবং নির্মাণের মানের দিক দিয়ে প্রকল্পটি সবার চেয়ে এগিয়ে রয়েছে।’
২০১৮ সালে তুরস্কের পরিবেশ ও নগরায়ণ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্যের বরাতে বলা হয়, দেশটির ৫০ শতাংশ বা প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ ভবন নির্মাণের সময় আইন মানা হয়নি।
সোমবার ভোরে তুরস্ক ও সিরিয়া সীমান্তবর্তী অঞ্চলে আঘাত হানা ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৮। এই মাত্রার ভূমিকম্প খুবই শক্তিশালী। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবনগুলো যদি মান বজায় রেখে নির্মাণ করা হতো, তাহলে এই ভূমিকম্পের পরও সেগুলো টিকে থাকার কথা ছিল।
এ নিয়ে কথা বলছিলেন যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের ইমার্জেন্সি প্ল্যানিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ডেভিড আলেকজান্ডার। তিনি বলেন, ‘এই ভূমিকম্পের তীব্রতা ছিল ব্যাপক। তবে অতটাও নয় যে শক্তপোক্তভাবে নির্মাণ করা ভবনগুলো ধসে পড়বে। বেশির ভাগ এলাকায় কম্পন ছিল সেদিনের সর্বোচ্চ মাত্রার চেয়ে কম। তাই আমরা এটা বলতে পারি যে হাজার হাজার ভবন—যেগুলো ধসে পড়েছে, সেগুলোর প্রায় সবই ভূমিকম্পসংক্রান্ত নির্মাণ বিধি মেনে গড়ে তোলা হয়নি।’
ইমারত বিধি প্রয়োগে ব্যর্থতা
বিভিন্ন সময় ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়ে সর্বশেষ ২০১৮ সালে তুরস্কে কঠোর আইন প্রণয়ন করা হয়। এর আগে ১৯৯৯ সালে দেশটির উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলে ইজমিত শহর ঘিরে শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল। সে সময় ১৭ হাজার মানুষ প্রাণ হারান। ওই ঘটনার পরও ভবন নিরাপত্তাসংক্রান্ত নীতিমালা জোরদার করা হয়েছিল।
তুরস্কের ইমারত বিধি অনুযায়ী, ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকাগুলোতে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে উচ্চমানের কংক্রিট ও ইস্পাতের কাঠামো ব্যবহার করতে হবে। আর ভবনের কলাম ও বিমগুলো এমন নকশায় স্থাপন করতে হবে, যেন ভূমিকম্পের সময় কম্পন সহ্য করে টিকে থাকতে পারে। তবে এ আইনগুলো খাতা–কলমেই আছে, বাস্তবে প্রয়োগ খুব কমই হয়।
এ নিয়ে অধ্যাপক ডেভিড আলেকজান্ডারের ভাষ্য, তুরস্কে যে ভবনগুলো আগে থেকেই আছে, সেগুলো অতটা মানসম্মত কাঁচামাল দিয়ে নির্মাণ করা হয়নি। আর বর্তমানে যেসব ভবন নতুন নির্মাণ করা হচ্ছে, সেখানেও আইন মানা হচ্ছে না।
আইন প্রয়োগে ব্যর্থতা কেন
তুরস্কে কোনো ভবন নির্মাণের সময় নিরাপত্তাসংক্রান্ত নীতিমালা না মানার পরও নির্মাতারা নির্দিষ্ট পরিমাণ জরিমানা দিয়ে ‘ক্ষমা’ পেতে পারেন। গত শতকের ষাটের দশক থেকে এ সুযোগ দিয়ে আসছে তুরস্ক সরকার। এ ক্ষমার কারণে দেশটিতে শক্তিশালী কোনো ভূমিকম্প বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলে বহু আগে থেকে সতর্ক করে আসছিলেন বিশেষজ্ঞরা।
তুরস্কের ইউনিয়ন অব চেম্বারস অব টার্কিশ ইঞ্জিনিয়ারস এবং আর্কিটেক্টস চেম্বার অব সিটি প্ল্যানার্সের ইস্তাম্বুলের প্রধান পেলিন পাইনার গিরিতলিওগলুর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সোমবারের ভূমিকম্পে তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোয় প্রায় ৭৫ হাজার ভবন ওই ক্ষমার আওতায় এসেছিল।
এ ছাড়া ভূমিকম্পের কয়েক দিন আগে তুরস্কের গণমাধ্যমগুলোয় একটি খবর বেরিয়েছিল। সেখানে বলা হয়, দেশটিতে নতুন একটি খসড়া আইন পার্লামেন্টের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। সেটি অনুমোদন পেলে পুরোনো ভবনের পাশাপাশি সাম্প্রতিক ভবনগুলোও নিয়ম না মেনে নির্মাণের পর ক্ষমার সুযোগ পাবে।
এ নিয়ে চলতি বছরের শুরুতেই ভূতত্ত্ববিদ সেলাল সেনগর বলেছিলেন, তুরস্কের মতো দেশে, যেখানে একাধিক সক্রিয় ফল্ট লাইন রয়েছে, সেখানে নির্মাণসংক্রান্ত এমন ক্ষমার আইন যদি পার্লামেন্টে অনুমোদন দেওয়া হয়, তা হবে একটি ‘অপরাধ’।
২০২০ সালে তুরস্কের পশ্চিমাঞ্চলে ইজমির প্রদেশে একটি ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল। ওই ভূমিকম্পের পর বিবিসি তুরস্কের একটি প্রতিবেদনে উঠে আসে, ইজমিরের ৬ লাখ ৭২ হাজার ভবন দেশটির সরকারের ক্ষমার সুযোগ পেয়েছিল। ওই প্রতিবেদনে ২০১৮ সালে তুরস্কের পরিবেশ ও নগরায়ণ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্যের বরাতে বলা হয়, দেশটির ৫০ শতাংশ বা প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ ভবন নির্মাণের সময় আইন মানা হয়নি।
সোমবারের ভূমিকম্পের পর তুরস্কে ভবন নির্মাণের মান নিয়ে কথা বলতে বিবিসি যোগাযোগ করেছিল পরিবেশ ও নগরায়ণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে। তবে তারা সাফ জানিয়ে দেয়, ‘আমাদের প্রশাসনের তৈরি কোনো ভবন ভূমিকম্পে ধসে পড়েনি। মাঠপর্যায়ে কতটা ক্ষতি হয়েছে তা দ্রুত যাচাই করা হচ্ছে।’