পুতিনের কাছে আসা কিমের সঙ্গে বসতে চায় যুক্তরাষ্ট্র, কিন্তু কীভাবে জানা নেই
দশকের পর দশক ধরে পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে ওয়াশিংটন এক প্রশ্ন নিজেদের করে আসছে— কীভাবে উত্তর কোরিয়া ‘সমস্যার’ সমাধান করা যায়? এখন এই প্রশ্ন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত উত্তর কোরিয়ার কিম জং–উন ও রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিনের বন্ধুত্বে ‘নব অধ্যায়ের’ সূচনা হয়েছে। তবে সার্বিক পরিস্থিতি বলছে, ‘বুদ্ধির’ সংকটে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
মস্কো ও পিয়ংইয়ংয়ের মধ্যে হওয়া যেকোনো চুক্তির বিস্তারিত কখনোই তেমন একটা জানা যায় না। তবে পশ্চিমাদের কাছে এখন সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে দুই দেশের সামরিক প্রযুক্তি বিনিময়ের বিষয়টি। পশ্চিমের ধারণা, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও পরমাণু শক্তিচালিত সাবমেরিনের মতো ‘স্পর্শকাতর’ নানা সামরিক প্রযুক্তি উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে ভাগাভাগি করছে রাশিয়া। এটাই এখন পশ্চিমাদের বড় উদ্বেগের বিষয়।
সম্প্রতি রাশিয়ার বন্দর নগরী ভ্লাদিভস্তকে পুতিন ও কিমের বৈঠক হয়েছে। এ বৈঠক নিয়ে এখন পর্যন্ত উপহাসই করতে দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্রকে। ওয়াশিংটনের মুখপাত্র বলেছেন, পুতিন এখন এতটাই মরিয়া হয়ে উঠেছেন যে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন একটি দেশের কাছেও তিনি সাহায্য ভিক্ষা করছেন। অবনত চিত্তে পুতিন ছুটে গেছেন নিজের দেশেরই একেবারে শেষ সীমানায়। এর পরিণাম হবে মারাত্মক। তবে সেই পরিণাম কী হবে, সেটি অবশ্য বলেনি।
তবে মজার বিষয় হলো, উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার মতো তেমন কোনো উপায়ও আর যুক্তরাষ্ট্রের হাতে নেই। বিষয়টি নিয়ে মার্কিন এক সাংবাদিককে মশকরা করতে দেখা গেল সেদিন। ওই সাংবাদিক বলেন, পিয়ংইয়ংয়ে কোনো আবাসিক এলাকার হয় তো একটি বা দুটি মুদিদোকান নিষেধাজ্ঞার তালিকায় নেই।
এমন এক পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কীভাবে তাহলে উত্তর কোরিয়ার খ্যাপাটে নেতা কিমকে আলোচনার টেবিল বসাবেন। কারণ, তিনি তো চীনবিরোধী জোট গঠনে এখন বেশি ব্যস্ত।
গত বছরের মে মাসে সিউল সফর করেন বাইডেন। এ সময় সাংবাদিকেরা তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, কিমকে তিনি কোনো বার্তা দিতে চান কি না। এর উত্তরে বাইডেন সেদিন শুধু ‘হ্যালো’ বলেছিলেন।
বিশ্বব্যাপী চলমান সংঘাত নিরসন ও সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করে যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট অব পিস। সংস্থাটির উত্তর–পূর্ব এশিয়া বিশেষজ্ঞ ফ্রাঙ্ক অম। তিনি বলেন, ‘পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে যে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, সে অনুযায়ী বাইডেন যদি সত্যিই কিমের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চান, তাহলে সেই আগ্রহ দেখানোর এমন ইঙ্গিত হাস্যকর।’
ফ্রাঙ্ক অম বলেন, ‘বিগত সাত দশক ধরে দুই দেশের পক্ষ থেকে একের পর এক ভুল পদক্ষেপ ও সুযোগ হাতছাড়া করার কারণে সব মিলে এমন একটা অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে যেটা বর্তমানে আমরা দেখতে পাচ্ছি।’
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় কিমকেও আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে না। যেকোনো সময় যেকোনো স্থানে আলোচনায় বসতে আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া এমন প্রস্তাবে এখনো তিনি কোনো সাড়া দেননি। একই সঙ্গে তিনি যে একজন বড় হুমকি, সেটা প্রমাণ করাও অব্যাহত রেখেছেন। পারমাণবিক অস্ত্রাগার তৈরির কাজ জোরকদমে চালাচ্ছেন। এ ছাড়া ২০২২ সাল থেকে তিনি শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছেন। এর মধ্যে দুবার গুপ্তচর স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের চেষ্টা করেছিলেন। যদিও দুবারই ব্যর্থ হয়েছেন। এর সবকিছুই হয়েছে যখন উত্তর কোরিয়ার ওপর সবচেয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ ছিল।
ফ্রাঙ্ক অম বলেন, ‘আমার ধারণা, আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবিলায় উত্তর কোরিয়ার অনড় অবস্থান ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকার বিষয়টি অবমূল্যায়ন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বিভিন্ন প্রেসিডেন্টের সময়ে অনেকে সম্ভবত নিরাপত্তা হুমকির দিক থেকে উত্তর কোরিয়াকে তৃতীয় পর্যায়ের ধরে নিয়েছিল। উত্তর কোরিয়া যতটা গুরুত্বের দাবিদার, তাকে সেটি দেওয়া হয়নি। এ কারণে দেশটি দিনের পর দিন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে যাচ্ছে।’
বেলজিয়ামের ব্রাসেলসভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের কোরিয়াবিষয়ক বিশ্লেষক ক্রিস্টোফার গ্রিন। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, যুক্তরাষ্ট্র ভাবছে, প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণই এখন তাদের জন্য সবচেয়ে ভালো কৌশল। এর কারণটাও আমার জানা। পরিস্থিতি এখন এমন, যেখানে বিগত কয়েক দশকের চেয়ে উত্তর কোরিয়া এখন রাশিয়া ও চীনের ওপর বেশি নির্ভর করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এখন এমন কী আছে যে তার প্রতিক্রিয়া জানাবে উত্তর কোরিয়া?’
ক্রিস্টোফার গ্রিন বলেন, সৃজনশীল কূটনীতিকে স্বাগত জানানো হবে। তবে একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় না এখনই সামনে এমন কোনো উপায় আছে।’
এদিকে আবার উত্তর কোরিয়া প্রশ্নে বেইজিং গুরুত্বপূর্ণ এক ‘খেলোয়াড়’। কারণ, মস্কো আর পিয়ংইয়ংয়ের সঙ্গে বেইজিংয়ের আছে সুসম্পর্ক। অন্য দিক বিবেচনায় নিলে রাশিয়া–উত্তর কোরিয়ার মধ্যে মিত্রতা বেইজিংয়ের স্বার্থেই ভালো। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবিলায় এই মিত্রতাকে খুব গুরুত্বের চোখেই দেখছে চীন।