মালদ্বীপে চীনের প্রভাব ভারতের নিরাপত্তার জন্য কতটা উদ্বেগের
মালদ্বীপ সরকার গতকাল মঙ্গলবার জানিয়েছে, সর্বশেষ স্বাক্ষরিত চুক্তির আওতায় চীন তাদের ‘সামরিক সহায়তা’ দেবে। এই চুক্তির মাধ্যমে ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রটি চীনের দিকে আরও বেশি ঝুঁকে যাওয়ার ইঙ্গিত দিল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। প্রেসিডেন্ট মোহামেদ মুইজ্জু ক্ষমতায় আসার পর থেকে চীনের দিকে সম্পর্ক উন্নয়নে নজর দেন।
মালদ্বীপের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক্স হ্যান্ডেলে (সাবেক টুইটার) এক পোস্টে জানিয়েছে, গত সোমবার বেইজিংয়ের সঙ্গে তাঁর দেশ ‘সামরিক সহযোগিতা’ চুক্তি করেছে। এই চুক্তি দুই দেশের ‘দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জোরদার’ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কী ধরনের সহায়তা চীন দেবে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি। তবে মন্ত্রণালয় বলেছে, চীন নিঃশর্তভাবে বা বিনা মূল্যে তাদের সামরিক সহায়তা দেবে।
গত বছরের নভেম্বরে মোহামেদ মুইজ্জু ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার ব্যাপারে জোর দেন। তিনি ‘ইন্ডিয়া আউট’ স্লোগান দিয়ে নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসেন। তিনি তখন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি জয়ী হলে মালদ্বীপের মাটি থেকে ভারতের সৈন্যদের সরিয়ে দেবেন। একই সঙ্গে দেশের সার্বভৌমত্ব ফিরিয়ে আনবেন।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে মুইজ্জু সরকার ঘোষণা দিয়েছে, ১৫ মার্চের মধ্যে মালদ্বীপে থাকা ভারতীয় সেনাদের প্রত্যাহার করে নিতে হবে। তবে গত মাসে প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে হালনাগাদ তথ্যে বলা হয়, ভারত ও মালদ্বীপের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে ঠিক হয়েছে, ধাপে ধাপে সৈন্য সরিয়ে নেওয়া হবে। প্রথম ধাপে ১০ মার্চ এবং দ্বিতীয় ধাপে ১০ মের মধ্যে সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের তথ্যমতে, মালদ্বীপে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর ৭৭ সেনাসদস্য ও ১২ স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন। ভারত মালদ্বীপকে দুটি হেলিকপ্টার ও একটি ডর্নিয়ার বিমান দিয়েছে। এগুলো মূলত সমুদ্রে নজরদারি এবং দুর্যোগের সময় উদ্ধার অভিযান ও অসুস্থ ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হয়।
চীনের সঙ্গে নতুন চুক্তির ফলে মালদ্বীপের পররাষ্ট্রনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে। মুইজ্জুর পূর্বসূরি ভারতপন্থী হিসেবে পরিচিত প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন।
দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষুদ্র এই দ্বীপরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক পর্যটন গন্তব্য হিসেবে বেশ সুপরিচিত। তবে প্রায় ১ হাজার ২০০ দ্বীপ নিয়ে গঠিত এবং পাঁচ লাখের কম জনসংখ্যার এই রাষ্ট্রের আরেকটি গুরুত্ব রয়েছে। ভারত মহাসাগর দিয়ে জাহাজ চলাচল ও আন্তর্জাতিক সমুদ্র বাণিজ্যের জন্য এই পথের গুরুত্ব অপরিসীম।
ভৌগোলিক নৈকট্য এবং ঐতিহাসিক ও শক্তিশালী অর্থনৈতিক সম্পর্কের কারণে কয়েক দশক ধরে ভারত মালদ্বীপের বেশ ঘনিষ্ঠ অংশীদার। নয়াদিল্লি ঐতিহাসিকভাবে এই অঞ্চলকে তার প্রভাব বলয়ের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে থাকে।
কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ভারত ও চীনের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে মালদ্বীপ। দুই দেশই এখানে নিজেদের প্রভাব সুসংহত করতে চায়।
চীন ধীরে ধীরে মালদ্বীপে তার প্রভাব বাড়িয়ে চলেছে। ২০ কোটি ডলার ব্যয়ে চীন-মালদ্বীপ মৈত্রী সেতু নির্মাণসহ বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরির মাধ্যমে দেশটিতে চীনের প্রভাব দৃশ্যমান হতে থাকে।
বিশ্লেষকেরা ইতিপূর্বে সিএনএনকে বলেছেন, মালদ্বীপে চীনের উপস্থিতি ভারতের নিরাপত্তায় প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ, মালদ্বীপে চীন অবস্থান নিতে পারলে ভারতের পশ্চিম উপকূল তাদের নাগালের মধ্যে চলে আসবে।
গত জানুয়ারিতে মোহামেদ মুইজ্জু রাষ্ট্রীয় সফরে বেইজিংয়ে যান। সেখানে দুই দেশ অবকাঠামো সহযোগিতা, বাণিজ্য, অর্থনীতি, সবুজ উন্নয়ন, অনুদান, অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পসহ ২০টি চুক্তি স্বাক্ষর করে।
মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে দেওয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এসব চুক্তির মধ্যে রাজধানী মালে রাস্তাঘাট উন্নয়নে ১২ কোটি ৭০ লাখ এবং ৩০ হাজার সামাজিক আবাসন ইউনিট করার চুক্তিও রয়েছে।
সফরকালে মুইজ্জু চীনকে মালদ্বীপের ‘অন্যতম ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং উন্নয়ন অংশীদার’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং গত মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, মালদ্বীপের সঙ্গে একটি সমন্বিত কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারত্ব গড়ে তুলতে বেইজিং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
মাও নিং বলেন, মালদ্বীপ ও চীনের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক তৃতীয় পক্ষকে কোনো লক্ষ করে নয়। তৃতীয় কোনো পক্ষের কারণে এই সম্পর্ক নষ্ট হবে না।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি এক ভাষণে মুইজ্জু বলেন, দেশের ৯ লাখ বর্গকিলোমিটার এক্সক্লুসিভ অর্থনৈতিক অঞ্চলে সার্বক্ষণিক নজরদারি রাখতে মালদ্বীপকে অবশ্যই তার সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, মালদ্বীপের সমুদ্রসীমা ও উপকূল সম্পর্কে বিশদ জেনে যেতে পারে, এমন কোনো বিষয়ে বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে সরকার কোনো চুক্তি আর নবায়ন করবে না।