শ্রীলঙ্কার সংখ্যালঘু মুসলিম ও তামিলদের জীবন কতটা বদলাতে পারবেন অনূঢ়া

শ্রীলঙ্কার বামপন্থী প্রেসিডেন্ট অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে। গতকাল বৃহস্পতিবার পার্লামেন্ট নির্বাচনে ভোট দেওয়ার পর দলীয় সমর্থকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। কলম্বো, শ্রীলঙ্কা, ১৪ নভেম্বর ২০২৪ছবি: রয়টার্স

শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে গত বৃহস্পতিবার ভোটের দিন কলম্বোর একটি ভোটকেন্দ্র থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় আবদুল রহমান সাইয়্যাদু সুলাইমান নামের এক ব্যক্তি তাঁকে ডাকেন। একটু দাঁড়িয়ে তাঁর অভিযোগ শোনার অনুরোধ করেন। পুলিশ দ্রুত সুলাইমানকে ঘিরে ফেলে এবং সেখান থেকে চলে যেতে বলে।

সুলাইমান বলেন, ‘আমি চাই (অনূঢ়া) আমাদের মতো মানুষের দুর্দশার কথা শুনুক। সাবেক সরকার যখন কোভিড-১৯ মহামারির সময় একটি শিশুকে দাহ করে, তখন আমি তার প্রতিবাদ করেছিলাম। আমি আমার ধর্মের পক্ষে আওয়াজ তুলেছিলাম। মুসলিম জনগণ ন্যায়বিচার পায়নি।’

শ্রীলঙ্কার ২২৫ আসনের পার্লামেন্টে ১৫৯ আসন জিতেছে এনপিপি। দুই-তৃতীয়াংশ আসন নিয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গঠনের জন্য যা যথেষ্ট। দেশটির অতীত ইতিহাসে এমনটা কখনো দেখা যায়নি।

সুলাইমান আশা করছেন, অনূঢ়া তাঁদের সঙ্গে ন্যায়বিচার করবেন। সুলাইমানের মতো শ্রীলঙ্কার অনেক মানুষ একই আশা করেন। যে কারণে গত সেপ্টেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন অনূঢ়া।

সুলাইমানের মতো মানুষের আশা আসলে কতটা পূরণ হবে, এবার তার পরীক্ষা। কারণ, শুধু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেই নয় বরং গত বৃহস্পতিবার দেশটির পার্লামেন্ট নির্বাচনে অনূঢ়ার দল ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি) বড় জয় পেয়েছে। শ্রীলঙ্কার ২২৫ আসনের পার্লামেন্টে ১৫৯ আসন জিতেছে এনপিপি। দুই-তৃতীয়াংশ আসন নিয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গঠনের জন্য যা যথেষ্ট। দেশটির অতীত ইতিহাসে এমনটা কখনো দেখা যায়নি।

এনপিপির প্রধান প্রতিপক্ষ সমাগি জনা বালাবেগায়া (এসজেবি) ৪০টি আসন পেয়েছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহের দল নিউ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট পেয়েছে মাত্র পাঁচটি আসন। গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে দেশটির রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে যাওয়া রাজাপক্ষে পরিবারের দল এসএলপিপি মাত্র তিনটি আসনে জয়লাভ করেছে।

সেপ্টেম্বরে অনূঢ়া যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তখন দেশটির পার্লামেন্টে তাঁর নির্বাচনী জোট এনপিপির আসন ছিল মাত্র তিনটি। পার্লামেন্টে নিজ জোটের আসনসংখ্যা বাড়াতে তিনি আগাম নির্বাচন দেন। এখন তাঁর জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করল।

কলম্ব থেকে নির্বাচন করে জয়ী হওয়া এনপিপি নেতা সমনমলী গুণাসিংহে বলেন, ‘আমরা খুশি, এখন আমরা জনগণের জন্য কাজ করতে পারব। তারা (জনগণ) দেখিয়েছে পুরোনো ধারার রাজনীতি থেকে তারা বেরিয়ে আসতে চায়।’

‘আমার মা খুবই অসুস্থ। তার বয়স হয়েছে, আমি তার দেখাশোনা করি। দৈনন্দিন জীবন চালানো আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। খাবারের দাম অনেক বেশি, ওষুধ হাতের নাগালের বাইরে। আমরা আশা করছি, পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন হবে।’
কলম্বোর ভোটার এম এফ সারিনা

পরিবর্তনের জন্য ভোট

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অরুণা কুলাতুঙ্গা বলেন, ১৯৭৭ সালের পর এই প্রথম শ্রীলঙ্কায় পার্লামেন্ট ব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে পরিবর্তন দেখা গেছে। সেখানে এই প্রথম কোনো একটি দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। সেই সঙ্গে দেশটিতে প্রথমবার ক্ষমতাসীন কোনো প্রেসিডেন্টের দল পার্লামেন্টে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল। সরকার গঠনে অন্য কোনো দল বা জোটসঙ্গীর প্রয়োজন তাদের পড়বে না।

এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক আরও বলেন, ভোটের এই ফলাফল গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক ভিত্তি এবং জাতি, ধর্ম ও মতাদর্শগত পার্থক্যের কারণে যে বিভেদ, তা পেরিয়ে সবাই একক কোনো দলের পেছনে একজোট হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। আগের জোট সরকারগুলোকে অংশীদার দলের মতামত ও পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব দিতে হয়েছে। ফলে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে তাদের দুর্বল হয়ে পড়তে হয়েছে।

দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে অনূঢ়ার দল এখন সংবিধান সংশোধন করার সুযোগ পাবে। এনপিপি এর আগে সংশোধনের মাধ্যমে সংবিধানের নতুন রূপ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।

অনূঢ়ার মার্ক্সবাদী জনতা বিমুক্তি পুরামুনার নেতৃত্বে গঠিত এনপিপির কাছে জনগণের প্রত্যাশা অনেক বেশি। নাগরিক সমাজের একাধিক দলসহ বিভিন্ন সংস্থা মিলে এনপিপি গঠিত হয়েছে।

২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের বিরুদ্ধে যে গণ–আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, সে সময়ে এনপিপি সংগঠিত হয়। গণ–আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন গোতাবায়া।

কলম্বোয় দিনমজুরের কাজ করেন ৩৮ বছরের বসন্ত রাজ। তিনি বলেন, তাঁর এলাকায় এনপিপি প্রার্থীর নামও তিনি জানেন না। তারপরই তিনি তাঁকে ভোট দিয়েছেন। তিনি মূলত এনপিপি জোটকে ভোট দিয়েছেন। দলের প্রার্থী কে ছিলেন, সেটা তাঁর কাছে কোনো বিষয় নয়।

বসন্ত বলেন, ‘বছরের পর বছর ধরে আমরা একই মানুষকে ভোট দিয়ে গেছি এবং কোনো পরিবর্তন আসেনি। এবার আমরা দেখতে চাই তারা (এনপিপি) কী করে।’

‘ভোটের এই ফলাফল গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক ভিত্তি এবং জাতি, ধর্ম ও মতাদর্শগত পার্থক্যের কারণে যে বিভেদ, তা পেরিয়ে সবাই একক কোনো দলের পেছনে একজোট হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। আগের জোট সরকারগুলোকে অংশীদার দলের মতামত ও পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব দিতে হয়েছে। ফলে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে তাদের দুর্বল হয়ে পড়তে হয়েছে।’
রাজনীতি বিশ্লেষক অরুণা কুলাতুঙ্গা

এনপিপির উত্থান

২০২২ সালের বিক্ষোভের পর শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে দ্রুত উত্থান হয় অনূঢ়ার। তিনি দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা ও সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতি দমনের ওপর জোর দিয়ে নির্বাচনী প্রচার চালান। বিক্ষোভের সময় শ্রীলঙ্কার ক্ষমতার লাগাম ছিল রাজাপক্ষে পরিবারের হাতে। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার ভাই মাহিন্দা রাজাপক্ষে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। বিপর্যস্ত অর্থনীতি ও ব্যাপক আকারে দুর্নীতি বন্ধের দাবিতে শুরু হওয়া ওই গণ বিক্ষোভের মুখে দুই রাজাপক্ষে ভাই ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যান।

সে সময় ক্ষমতায় আসেন রনিল বিক্রমাসিংহে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ এবং আরও কয়েকটি মাধ্যম থেকে ঋণ নিয়ে দেশের অর্থনীতি অনেকটাই স্থিতিশীল করতে সক্ষম হন বিক্রমাসিংহে। কিন্তু আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, তাঁকে নানা বিষয়ে কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনের পথে হাঁটতে হয়েছে। তিনি কঠোর হাতে নানা সামাজিক নিরাপত্তা ব্যয় কমিয়ে আনেন ও কর বৃদ্ধি করেন। যা নিয়ে জনমনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়।

কলম্বোয় একটি ভোটকেন্দ্রের বাইরে ৮৩ বছর বয়সী মাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন ৬৩ বছরের এম এফ সারিনা। তিনিও আশা করছেন, নতুন সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করবে ও গরিব মানুষের ওপর থেকে চাপ কমাবে। তিনি বলেন, ‘আমার মা খুবই অসুস্থ। তার বয়স হয়েছে, আমি তার দেখাশোনা করি। দৈনন্দিন জীবন চালানো আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। খাবারের দাম অনেক বেশি, ওষুধ হাতের নাগালের বাইরে। আমরা আশা করছি, পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন হবে।’

গত শুক্রবার ভোটের পূর্ণ ফলাফল প্রকাশের পর এনপিপির সম্পাদক নিহাল আবেসিংহে তাঁর দলের ওপর মানুষের প্রত্যাশার চাপ স্বীকার করে নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা এটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারি যে আগের লোকজনের মতো করে আমরা ক্ষমতার অপব্যবহার করব না।’

আরও পড়ুন

তামিলদের সমর্থন

শ্রীলঙ্কার উত্তরের তামিল জনগণ এবার অতীতের পথে হাঁটেনি। তাঁরা এবার তামিল রাজনৈতিক দলগুলোকে নয় বরং ব্যাপকভাবে এনপিপিকে ভোট দিয়েছে। উত্তরের বেশির ভাগ আসন তাই এনপিপির ঘরে গেছে। প্রায় তিন দশক ধরে তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর লড়াই চলেছে। তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নেতা নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে ২০০৯ সালে রক্তক্ষয়ী ওই গৃহযুদ্ধের অবসান হয়।

জাফনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আহিলান কাদিরগামার বলেন, হয়তো তামিল ভোটাররা তাঁদের সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক নেতাদের ওপর ক্ষুব্ধ। কারণ, তাঁরা তামিল জনগণের জন্য ভালো কিছু করার প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। এ জন্য এবার তামিল ভোটাররা গণহারে এনপিপিকে ভোট দিয়েছেন।

শ্রীলঙ্কার উত্তর ও পূর্বাঞ্চল তামিল–অধ্যুষিত। এই শিক্ষক বলেন, এনপিপির আসল কাজ এখন শুরু হবে। নতুন সরকারকে ওই দুই অঞ্চলের মানুষের উদ্বেগের সমাধান করতে হবে। বিশেষ করে গৃহযুদ্ধের সময় দেশটির সেনাবাহিনী ও অন্যান্য সরকারি দপ্তর তামিলদের যেসব ভূমি দখল করছে, সরকারকে সেগুলো অবশ্যই ফিরিয়ে দিতে হবে।

আহিলান কাদিরগামার আরও বলেন, সরকারকে অবশ্যই সংখ্যালঘু তামিল ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের উদ্বেগের সমাধান করতে হবে। তারাই দেশটিতে জাতিগত বিদ্বেষের শিকার বেশি হয়। এই উদ্বেগের সমাধান করা ‘সহজ হবে না’ বলে মনে করেন তিনি।

আরও পড়ুন