কাট সিলভিয়ার দুই বছর বয়সী মেয়ের চোখের দিকে শেষবার তাকানোর ব্যথাতুর স্মৃতি এখনো দগদগে হয়ে আছে। ২০ বছর আগে আজকের দিনটি উত্তর সুমাত্রার বান্দা আচেহ শহরে অন্য দশটি দিনের মতোই শুরু হয়েছিল। কিন্তু সিলভিয়া আচমকা দেখলেন, তাঁদের বাসার সামনে দিয়ে মানুষ দৌড়ে পালাচ্ছে। দৌড়াতে দৌড়াতে তারা বলছে, পানি আসছে, পানি...।
শিশুকন্যা সিথিকে বুকে জড়িয়ে কী করবেন, তা ভেবে ওঠার আগেই কাট সিলভিয়াদের বাসায় সাগরের ঢেউ আছড়ে পড়তে শুরু করে। কয়েক মিনিটের মধ্যে এসব হয়ে গেল। এতে তিনি হতভম্ব হয়ে যান।
সিলভিয়া আল–জাজিরাকে বলেন, ‘তার (সিথি) চোখের দিকে তাকানো এবং আমার চোখের দিকে তার তাকানোর সেই মুহূর্ত আমি বর্ণনা করতে পারব না। আমরা একে অপরের দিকে বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে ছিলাম।’
‘এমনকি সে কান্না পর্যন্ত করতে পারছিল না, কোনো শব্দও করতে পারছিল না। সে কেবল ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি জেনে গিয়েছিলাম যে আমরা আলাদা হয়ে যাচ্ছি’, বলছিলেন সিলভিয়া।
সুনামি সিথিকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
সিলভিয়া দৌড়াচ্ছিলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল, তিনি ‘ওয়াশিং মেশিনের’ মধ্য দিয়ে দৌড়াচ্ছেন। এভাবে প্রায় ১৫ মিনিট দৌড়ানোর পর তিনি একটি বাসার ছাদে উঠতে সক্ষম হন। এরপর তিনি ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে শুরু করেন, কী বিশাল ধ্বংসযজ্ঞই না হয়ে গেল।
সিলভিয়া বলেন, ‘আমার খুব, খুব বেশি মন খারাপ হয়ে যায়। আমার মেয়ে নেই, তা ভাবতেই কী রকম মন খারাপ হয়েছিল, সেই অনুভূতি আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।’
সিলভিয়ার স্বামী বুদি পারমানাও সুনামির তোড়ে ভেসে গিয়েছিলেন। ভেসে যেতে যেতে তিনি একটি নারকেলগাছের চূড়ায় আটকে গিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে পরিবারের সদস্যদের খুঁজতে গিয়ে ক্লান্ত–বিধ্বস্ত হয়ে তিনি হাঁটাচলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। বিধ্বস্ত অবস্থায় তাঁকে রেডক্রসের সদস্যরা খুঁজে পেয়েছিলেন। শুরুতে তাঁরা তাঁকে মৃত ভেবেছিলেন।
সিলভিয়া ও বুদি এক সপ্তাহ পরে মেদান শহরে পরস্পরের দেখা পান। এ শহরটি তাঁদের নিজেদের শহর বান্দা আচেহ থেকে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
এর পর থেকে এখন পর্যন্ত সিথির কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।
নিজেদের ছোট মেয়ের ভাগ্যে কী ঘটেছিল, তা জানতে না পারার শোক এই দম্পতিকে এখনো তাড়িয়ে বেড়ায়। ২০ বছর আগে ভারত মহাসাগরের এই সুনামি ছিল মানব ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি প্রাণঘাতী ও সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক।
আশার কথা হলো, ইন্দোনেশিয়ায় ২০০৪ সালে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একটি মেয়ে ১০ বছর পর ২০১৪ সালে পরিবারকে খুঁজে পেয়েছে। সুনামির সময় তার বয়স ছিল চার বছর।
এই ঘটনা থেকে এখনো আশায় বুক বেঁধে আছেন সিলভিয়া ও বুদি। তাঁদের আশা, কোনো একদিন তাঁরাও তাঁদের দুই বছর বয়সে সুনামিতে নিখোঁজ সিথির দেখা পাবেন।
‘সবকিছু ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল’
২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর। সকাল আটটার কিছুক্ষণ আগে ইন্দোনেশিয়ার উত্তর সুমাত্রার আচেহ প্রদেশের পশ্চিম উপকূলে ৯ দশমিক ২ থেকে ৯ দশমিক ৩ মাত্রার একটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। ভারত মহাসাগরে উৎপন্ন এ ভূমিকম্পের কারণে মানব ইতিহাসের ভয়াবহতম সুনামির সৃষ্টি হয়। ১৪টি দেশে প্রায় ২ লাখ ২৭ হাজার ৮৯৮ জন মানুষ প্রাণ হারান বা নিখোঁজ হন।
ইন্দোনেশিয়ার পর সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল যথাক্রমে শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডে। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল থেকে সবচেয়ে বেশি দূরের দেশ হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকার শহর পোর্ট এলিজাবেথেও প্রাণহানি হয়েছিল। শুধু ইন্দোনেশিয়াতে মারা গিয়েছিলেন ১ লাখ ৩১ হাজার মানুষ।
২০ বছর আগে সুনামি নিয়ে আজকের মতো এতটা গবেষণা, সাগর প্রতিরক্ষা ও পূর্বাভাসের প্রযুক্তি ছিল না। কিন্তু গত দুই দশকে এসব খাতে বিপুল উন্নতি হয়েছে। তাই বলে সুনামি নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ, ২০০৪ সালের মতো ভয়াবহ সুনামি যেকোনো সময় আবার আঘাত হানতে পারে।
লন্ডন সাউথ ব্যাংক ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ডেভিড ম্যাকগভর্ন বলেন, সুনামি অতি বিপর্যয়কর কিছু নয়, এটি একটি ভুল ধারণা। প্রকৃতপক্ষে এটি একটি সাধারণ বিপর্যয়, যা যেকোনো সময় ঘটতে পারে।
উদাহরণ হিসেবে ম্যাকগভর্ন ওই ভয়াবহ সুনামির সাত বছরের মাথায় ২০১১ সালে জাপানে আঘাত হানা ভয়াবহ সুনামির কথা উল্লেখ করেন। বিশ্বে এখন পর্যন্ত নথিভুক্ত হওয়া চতুর্থ শক্তিশালী ভূমিকম্পের পর এই সুনামি আঘাত হেনেছিল।
আল–জাজিরাকে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, বছরে বিশ্বে গড়ে দুটি সুনামি হয়, যাতে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে।
ভারত মহাসাগরের সুনামির ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে গত ৬ ডিসেম্বর লন্ডনে একটি সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা হয়। সুনামি নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভোগার বিষয়টি ছিল এ সিম্পোজিয়ামের অন্যতম আলোচ্য বিষয়।
সিম্পোজিয়ামে বিশেষজ্ঞরা বলেন, সুনামি নিয়ে বোঝাপড়া বাড়ানোর কাজ অব্যাহত রাখতে হবে। এ বিষয়ে গবেষণায় বাজেট বাড়াতে হবে। গবেষণার নিত্যনতুন বার্তা সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে।